সাভারকর কি “কুইট ইন্ডিয়া” আন্দোলনের বিরোধিতা করে ব্রিটিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন?
সময় ও প্রেক্ষিত
বিয়াল্লিশের আন্দোলনে যোগ না দেওয়া
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন গান্ধীজির 'কুইট ইন্ডিয়া' আন্দোলনে নানা কারণে যাঁরা যোগ দেননি, তাঁদের লিস্ট বেশ লম্বা। যেমন, দলিত নেতা আম্বেদকর; মুসলিম লিগ নেতা জিন্না; অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট কনফারেন্স, কমিউনিস্ট পার্টি, নেহেরুর আশীর্বাদ ধন্য কিছু কিষাণ সভা এবং কিছু লিবেরাল জনতা, যাঁরা মনে করতেন জাপান জিতলে ভারত স্বাধীনতা পাবে। 1
এরা কেউ ব্রিটিশের দালাল নন, কিন্তু কমিউনিস্ট সমেত অনেকের গায়ে কংগ্রেস এই তকমাটা সেঁটে দিয়েছিল।
প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কারণ ছিল। যেমন কমিউনিস্ট পার্টির রাশিয়ার নেতৃত্বে জনযুদ্ধ; নেহেরুর ইচ্ছে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে প্রতিহত করা, আম্বেদকরের দলিত সমাজের জন্য স্বতন্ত্র অস্তিত্বের স্বীকৃতি, জিন্নার জন্য পাকিস্তানের স্বপ্ন সফল করা।
সাভারকরের কাছে এটা ছিল হিন্দু যুবকদের বিশেষ সুযোগ। ব্রিটিশ ফৌজে ঢুকে যুদ্ধবিদ্যা অস্ত্রচালনায় পারঙ্গম হয়ে আগামী দিনের মহাসমরের জন্য (মুসলিম মুক্ত ভারত) প্রস্তুত হওয়া। 2
হিটলারের জার্মানি 1938-এর মার্চে অস্ট্রিয়া দখল করায় সাভারকর হিটলারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটা ওঁর চোখে জার্মানির ‘ঐক্যবদ্ধ’ হওয়ার উদাহরণ! উনি মনে করলেন, এইভাবেই ‘হিন্দু ভারত’ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। নেহরুর হিটলার এবং মুসোলিনির নিন্দা সাভারকরের চোখে ‘অনাবশ্যক’। 3
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
সাভারকর চাইছিলেন ভারতীয় পুঁজি ও মজুর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠুক। তাই ব্রিটিশকে সমর্থন করতে হবে। হিন্দু যুবকেরা দলে দলে ফৌজে যোগ দিয়ে ব্রিটিশের থেকে আধুনিক সমরাস্ত্রের ব্যবহার এবং রণকৌশল শিখে নিক, যা ভবিষ্যতে কাজে আসবে। আম্বেদকর চাইছিলেন এই সময়ে ভারত ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীন থাকুক, এবং এখনই যেন কেন্দ্রে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন না ওঠে। কেননা, দলিতদের জন্য অনেক প্রশ্ন তখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। একমাত্র উনিই যুদ্ধে ব্রিটিশকে ১০০% নিঃশর্ত সমর্থনের পক্ষে ছিলেন। 4
সাভারকরের যুক্তিগুলো:
এক, ‘নিরস্ত্র, অসংগঠিত এবং একজোট না হওয়া’ জনতার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভাবা বাতুলতা।
দুই, গান্ধীজির পূর্ণ অহিংসার নীতি সশস্ত্র হামলার সামনে ভারতের, বিশেষ করে হিন্দুদের, লোকসান করবে।
তিন, ফৌজে হিন্দুদের সংখ্যা দ্বিতীয় শত্রু মুসলমানদের তুলনায় বাড়ানো খুব দরকার। উনি খুশি যে রিক্রুটমেন্টের নতুন নিয়মের ফলে একলাখ নতুন ভর্তির মধ্যে 60,000 হল হিন্দু। 5
সাভারকর স্পষ্ট কথায় বললেন, ‘হিন্দুদের সামরিকীকরণ এবং শিল্প গড়ে তোলা আমাদের বর্তমান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত’। 6 সাভারকরের হিন্দু মহাসভা একটি ‘হিন্দু মিলিটারাইজেশন বোর্ড’ গঠন করে যুবকদের আর্মি, নেভি এবং এয়ারফোর্সে যোগ দিতে আহ্বান করল। এই সময়ে হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশ ‘রাজ’-এর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নামতে একটি প্রস্তাব পাশ করলো। সেটা সাভারকর চেপে দিলেন এই বলে যে, ভারতের পূর্ব-পশ্চিম দুই প্রান্তে যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়েছে। এখন ‘মূর্খের মত জেলে ঢোকার কোনও প্রোগ্রাম’ শিকেয় তুলে রাখা উচিত। 7
1941 সালের ডিসেম্বর মাসে হিন্দু মহাসভার ভাগলপুর বার্ষিক অধিবেশনে ‘নিষেধাজ্ঞা অমান্য’ করে যোগ দিতে গিয়ে সাভারকর গয়া স্টেশনে গ্রেফতার হলেন। পুলিশের লাঠিচার্জ, তিনশ ভলান্টিয়ার গ্রেফতার। তবু সাভারকর জিভি. কেলকরের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া তাঁর সভাপতির অভিভাষণে বললেন, হিন্দুরা ‘এক মিনিট সময় নষ্ট না করে’ ফৌজে যোগ দিক। কারণ, জাপান অক্ষশক্তিতে যোগ দিয়েছে। এখন ব্রিটিশের শত্রুদের ভারতের মাটিতে ঠেকাতে আমাদের ভারত রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে সবরকমে সাহায্য করতে হবে। 8
রেঙ্গুনের পতনের (8 মার্চ, 1942) একদিন পরে ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান লিখল যে, সাভারকর চার্চিলকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে অনুরোধ করেছেন, এবার ইন্দো-ব্রিটিশ কমনওয়েলথে সমান ভাগীদারির ভিত্তিতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হোক। 9
চার্চিল 11 মার্চ, 1942-এ ভারতে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে পাঠানোর কথা ঘোষণা করলেন।
ক্রিপস মিশন 23 মার্চ, 1942-এ দিল্লি এসে প্রথমে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগকে আলোচনার জন্য ডাকলো, তারপর ডাকলো হিন্দু মহাসভা, দলিতদের প্রতিনিধি আম্বেদকর, শিখ এবং দেশি করদ রাজ্যসমূহের প্রতিনিধিদের। ক্রিপস প্রস্তাব, মুসলিম লিগ ছাড়া কারও পছন্দ হয়নি। সাভারকর খোলাখুলি বললেন যে, এই প্রস্তাবে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান গড়ার শর্ত থাকায় হিন্দু মহাসভার পক্ষে এতে সম্মত হওয়া সম্ভব ছিল না। 10
গত কয়েকবছর ধরে কংগ্রেস, স্বাধীনতা পাওয়ার শর্তে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ব্রিটিশের সঙ্গে দরাদরি করছিল। ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হওয়ায় গান্ধীজি অগাস্ট ’42-এ ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কংগ্রেস নেতাদের জেলে পোরা হল।
বোন বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিতের হিসেবে নেহেরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিরোধিতা করা নিয়ে বেজায় অস্বস্তিতে ছিলেন। জেলে ঢুকে যেন হাঁফ ছাড়লেন। 11
গান্ধীজির ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন নিঃসন্দেহে 1857’র সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারত জুড়ে সবচেয়ে বড় জন আন্দোলন বা স্বাধীনতার জন্য মহাজাগরণ। কিন্তু এর ফলে তিন বছর কংগ্রেসের নেতারা জেলে বন্দি রইলেন, পার্টির ফান্ড আটকে দেওয়া হল, সংগঠন নিষ্ক্রিয় রইল। খোলা মাঠে মুসলিম লিগ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচার চালিয়ে তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে পাকিস্তানের দাবিকে মজবুত করল।
সাভারকর জেলে বন্দি কংগ্রেসের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানিয়েও ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনকে ‘অসময়োচিত’ বলে সমালোচনা করে তাঁর ‘ফাইভ পয়েন্ট’ প্রস্তাব পেশ করলেন। যার মূলকথা হল,
যুদ্ধে পুরোপুরি সাহায্য পেতে হলে ব্রিটেন:
ক) ভারতকে স্বাধীন এবং সমান ‘পার্টনার’ ঘোষণা করুক।
খ) ভাইসরয়ের কাউন্সিল-এর পূর্ণ ভারতীয়করণ হোক।
গ) এবং তার নির্ণয় ভাইসরয়ের জন্য অবশ্য পালনীয় ঘোষণা করা হোক।
ঘ) যুদ্ধ শেষ হলে একটি সম্মেলন ডাকা হোক, যাতে জাতীয় সংবিধান রচনার খসড়া তৈরি করা যায় এবং স্বাধীনতার ঘোষণাকে বাস্তবায়িত করা যায়।
ঙ) এই শর্তগুলো মেনে নিলে গোটা ভারত ব্রিটেনকে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় পূর্ণ সহযোগিতা করবে। (হিন্দু মহাসভা গোড়া থেকেই করছিল।) 12
যুক্তরাজ্যের পাঁচটি নামী পত্রিকা- দ্য টাইমস, গার্ডিয়ান, ডেইলি হেরাল্ড, নিউজ ক্রনিকল এবং ইয়র্কশায়ার পোস্ট সাভারকরের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করলো। প্রবাসী ভারতীয়রা সেন্ট্রাল হলে আয়োজিত ইন্ডিয়ান লিগের সভায় এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। 13
কিন্তু চার্চিল একেবারে পাত্তা দিলেন না। উনি হাউস অফ কমন্সে, 10 সেপ্টেম্বর 1942-এ বললেন, ক্রিপস যোজনার ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস ইত্যাদি শর্ত আজও বহাল রয়েছে এবং ভারতের মাটিতে এখন এত ব্রিটিশ সৈন্য রয়েছে যা অভূতপূর্ব। 14
এই দাম্ভিক উক্তির বিরুদ্ধে সমস্ত রাজনৈতিক মহলে প্রতিবাদ হল। কিন্তু এরপর থেকে সাভারকর রাজনীতির আঙিনায় ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। কংগ্রেস সমর্থকদের সংখ্যা হিন্দু মহাসভার থেকে কয়েকগুণ বেশি ছিল এবং গান্ধীজির ‘কুইট ইন্ডিয়া’ ডাকের সমালোচকরাও একমত ছিলেন যে, জিন্নার পাকিস্তানের চাল ঠেকাতে শুধু কংগ্রেসই সক্ষম। তার থেকেও বড় ব্যাপার হল যে, অনেক হিন্দু মহাসভার সদস্যরাও সাভারকরের ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনের বিরোধিতা এবং হিন্দু যুবকদের দলে দলে ফৌজে যোগ দেওয়ার আহ্বান নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল।
সাভারকরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এন সি চ্যাটার্জি (প্রাক্তন স্পিকার, সিপিএম সদস্য সোমনাথ চ্যাটার্জির পিতা) এই ব্যাপারে আর এক সঙ্গী বি এস মুঞ্জেকে লিখলেন, ‘সমস্ত হিন্দু জনতা গান্ধীজির এবং তাঁর আন্দোলনের সঙ্গে রয়েছে। কেউ যদি এর বিরোধিতা করে, তবে সে বরাবরের মত শেষ হয়ে যাবে এবং রাজনীতির আঙিনা থেকে বিতাড়িত হবে। বীর সাভারকরের (বিয়াল্লিশের আন্দোলনের বিরোধিতা করে) দুর্ভাগ্যজনক বক্তব্যটি বাংলায় আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।’ 15
মারাঠি নাট্যকার, ব্যঙ্গলেখক এবং নবযুগ পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক পি কে আত্রে, যিনি পাঁচ বছর আগে সাভারকরকে সম্বর্ধনা সভায় ‘স্বতন্ত্রবীর’ টাইটেল দেওয়ায় কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের বিদ্রূপের স্বীকার হয়েছিলেন, তিনিই এখন সাভারকরকে ব্রিটিশ ফৌজের স্বার্থে ‘রিক্রুট-বীর’ এবং ‘কাঁচের ঘরে সাজানো সিংহ’ বলে হিন্দু মহাসভার সমর্থকদের হাতে দু-দুবার ঠ্যাঙানি খেলেন, কিন্তু মত বদলালেন না। 16
রাসবিহারী বসু মার্চ, 1942-এ (কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন শুরুর ঠিক আগে) টোকিও থেকে এক চিঠি লিখে সাভারকরকে অনুরোধ করলেন, যাতে উনি ব্রিটিশের এই দুর্বল সময়ে ওদের সমর্থন না করেন, শত প্রলোভন এমনকি স্বাধীনতার আশ্বাসেও বিশ্বাস না করেন। দেশের সব অনিষ্টের মূল ব্রিটিশ শক্তিকে ধ্বংস করতে জাপানের সঙ্গে হাত মেলালে কেমন হয়? 17
অগাস্ট, 42-এর শেষে সুভাষ চন্দ্র বোস জার্মানি থেকে এক রেডিও ব্রডকাস্টে বললেন, ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলনে ভারতবাসী জেগে উঠেছে, এবং এই আন্দোলন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে। উনি আরও বললেন, ‘আমি মি: জিন্নাহ, মি: সাভারকর এবং আরও যারা এখনও ব্রিটিশের সঙ্গে সমঝোতার কথা ভাবছেন, তাঁদের বলছি, তাঁরা শেষবারের মতো বুঝে নিন যে, আগামী দিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বলে কিছু থাকবে না। আজ যারা স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন, শুধু তাঁরাই স্বাধীন ভারতে সম্মান পাবেন এবং যাঁরা আজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে, স্বাভাবিকভাবেই তুচ্ছ বলে গণ্য হবেন’। 18
পাকিস্তান প্রস্তাব, দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং জিন্না ও সাভারকর
প্রশ্ন উঠেছিল ব্রিটিশরা কি ভারত ছাড়ার আগে দেশভাগ করে যাবে? এই ব্যাপারে জিন্না ও সাভারকরের অবস্থানগুলো দেখা যাক।
মুসলিম লিগের লাহোর প্রস্তাব (1940) নিয়ে বিতর্কে সাভারকর ভারতের মুসলিমবহুল এলাকাগুলো নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রবল বিরোধিতা করে বললেন, এই জন্যই হিন্দুদের যুদ্ধে গিয়ে সৈনিক অভ্যাসে পোক্ত হওয়া উচিত, তাহলে স্বাধীন ভারতে অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে হিন্দুরা আত্মরক্ষায় তৈরি থাকবে। 19
গান্ধীজির জিন্নাকে ভারত সরকার গঠনের প্রস্তাব এবং বক্তব্য, ‘আমি জিন্না-রাজত্বে থাকতে রাজি, কারণ তবু আমি ভারতীয়ই থাকব’-কে তীব্র সমালোচনা করে সাভারকর বলেন, মহাত্মার উচিত নয় মুসলমানদের এইসব ঝুঠকে উসকে দেওয়া এবং উনি হিন্দুদের সতর্ক করে বলেন যে, কংগ্রেস ধোঁকা দেবে। 20
সাভারকরের জীবনীলেখক বৈভব পুরন্দরের মতে, এখানে সাভারকর পুরোপুরি ‘জিন্নার হাতে খেললেন।’
1939 সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দু’মাস পরে হিন্দু মহাসভার কলকাতা অধিবেশনে উনি ‘নেশনহুড’-এর যে থিওরি পেশ করলেন, তা একেবারে জিন্নার তত্ত্বের প্রতিরূপ। কংগ্রেসের ভৌগলিক এলাকা (টেরিটোরি) ভিত্তিক নেশনহুড এর সমালোচনা করে সাভারকর বললেন, জাতীয়তার ভিত্তি হবে সংস্কৃতি, ভাষা, নরগোষ্ঠী (রেস) এবং ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। তাঁর মতে হিন্দু একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে উপরের সব শর্তগুলি পূর্ণ করেছে।
সমালোচকেরা ছেড়ে কথা বলেননি।
এস এ বেলভি বললেন, এই তত্ত্ব ‘ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক প্রহেলিকায় ভরপুর’ এবং জিন্নার মত সাভারকরও এক ‘সাইকো-পলিটিক্যাল কমপ্লেক্সের’ শিকার। 21
পাকিস্তানের পক্ষধর এবং ভারতে ইসলামিক সাম্রাজ্যের ফিরে আসার স্বপ্ন দেখা এফ কে খান দুরানি তুলে আনলেন 1937 সালে হিন্দু মহাসভার আমেদাবাদ অধিবেশনে সাভারকরের অভিভাষণ, যাতে ভারতের হিন্দু ও মুসলিমকে দুটো স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং কলকাতা অধিবেশনের অভিভাষণ স্পষ্টত ওই থিওরির আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা মাত্র।
দুরানির তাতে কোনও আপত্তি নেই, উনি আঙুল তুললেন সাভারকরের স্ববিরোধিতা নিয়ে। একদিকে সাভারকর মুসলিমদের স্বতন্ত্র ‘নেশন’ বলে স্বীকার করছেন, অন্যদিকে তাদের স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্বের অধিকারকে অস্বীকার করে গোটা ভারতকে হিন্দুদের পবিত্র ভূমি বলে ঘোষণা করছেন। 22
কংগ্রেসের সমাজবাদী গোষ্ঠীর অশোক মেহতা এবং অচ্যুত পটবর্ধন বললেন, সাভারকরের তত্ত্বের প্রেক্ষিত তাঁর ‘সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতদুষ্ট’, তবে দুরানির সমালোচনা করে এঁরা বললেন, ভারত বহু ন্যাশনালিটির দেশ হলেও এর মানে এই নয় যে, সবাই একটা করে আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র পাবে। 23
সবচেয়ে খুঁটিয়ে সমালোচনা বোধহয় আম্বেদকরের। সাভারকরের থিওরি, ওঁর মতে, ‘অযৌক্তিক এবং অদ্ভুত’। ‘মিঃ সাভারকর স্বীকার করছেন, মুসলিমরা এক স্বতন্ত্র জাতি (নেশন)। মানছেন ওদের সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তাধিকার, মেনে নিচ্ছেন ওদের আলাদা জাতীয় পতাকার কথা। অথচ মুসলিম নেশনের জন্য একটা আলাদা ‘হোম’ চাইলেই ওনার আপত্তি। উনি হিন্দুদের জন্য একটি ন্যাশনাল হোম চাইছেন, তাহলে কী করে মুসলিম নেশনের জন্যে আলাদা ‘হোমের’ দাবি অগ্রাহ্য করতে পারেন?’ 24
আম্বেদকর মনে করতেন, পাকিস্তান গঠন এবং অধিবাসীদের শান্তিপূর্ণ অদলবদল সবচেয়ে ভাল সমাধান। কারণ প্যান-ইসলামিজমের আকর্ষণে ভারতের মুসলমান নিজেদের ‘আগে মুসলমান পরে ভারতীয়’ ভাবে। 25
কিন্তু সাভারকরের হেঁয়ালি সমালোচকদের হাতে আরও অস্ত্র তুলে দিল। অক্টোবর 1939-এ প্রাদেশিক আইনসভাগুলো থেকে কংগ্রেস বিধায়করা পদত্যাগ করলে হিন্দু মহাসভা মুসলিম মন্ত্রীসভায় যোগ দিল। মানে, মুসলিম মেজরিটি অঞ্চলে আইনানুযায়ী ওদেরই বেশি প্রধিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করা হয়েছিল। ফলে অবিভাজিত বাংলা, সিন্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সরকার গঠনে, দল আলাদা হলেও, মুসলিম সমুদায়ের প্রধান ভূমিকা ছিল। যেমন, বঙ্গে কৃষক প্রজা দলের ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা, সিন্ধে মুসলিম লিগের হিদায়েতুল্লার এবং সীমান্ত প্রদেশে লিগেরই অওরঙ্গজেব খানের। সাভারকর ওইসব মন্ত্রীসভায় অল্পসংখ্যক হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার যুক্তিতে দলের লোকদের যোগ দিতে বললেন। 26
এরপর কংগ্রেসি ও অন্যান্য সমালোচকের চোখে মহাসভার বিধায়করা অনেক ব্যঙ্গবিদ্রূপের লক্ষ্য হয়ে উঠলেন। কারণ, সিন্ধ প্রাদেশিক সভা মার্চ, 1943-এ পাকিস্তানের পক্ষে প্রস্তাব পাশ করলো। মহাসভার বিধায়কেরা প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু সাভারকরের নির্দেশ মেনে পদত্যাগ করলেন না। 27
একটা বিষয় খেয়াল করার মত, পাঁচটা বছর (1939-43) ধরে জিন্না এবং সাভারকরের মধ্যে আলাপ-আলোচনার প্রয়াস চলে। দু’জনেই তখন কংগ্রেসের উপর বীতশ্রদ্ধ। কিন্তু সেই চেষ্টাগুলো হয়তো ব্যক্তিগত অহং বা অন্য কারণে বৈঠক অবধি গড়াল না। 28
ক্রমশ জিন্না এবং সাভারকর একে অন্যের আয়না হয়ে দাঁড়ালেন। জিন্না খোলাখুলি বললেন যে, সাভারকর বাকি সবাইকে বোকা ভাবেন। উনি একই সঙ্গে ফৌজে 75% হিন্দু ভর্তি করার সঙ্গে ব্রিটিশের কাছে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস চাইছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, ভারতে মিলিটান্ট হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন করা। 29
ইতিমধ্যে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কাছে গান্ধী এবং নেহেরু অধিক গ্রহণীয় হয়ে উঠেছেন এবং মুসলিমদের অধিকাংশের কাছে জিন্না। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ সম্পূর্ণ। 1945-46-এর কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সভার নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল ভোটে অধিকাংশ সিটে বিজয়ী হল। হিন্দু মহাসভা গোহারা হারল। কেন্দ্রীয় সভায় একটা সিটও পেল না। বোম্বে এবং সেন্ট্রাল প্রভিন্সে সবার জামানত জব্দ হল। বঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ একজন আনকোরা কংগ্রেসির কাছে হারলেন। 30
1946 নাগাদ ভগ্নস্বাস্থ্য সাভারকরের বয়েস তেষট্টি। সমস্ত দাঁত পড়ে গেছে, ঘুষঘুষে জ্বর ফিরে আসছে, দুটো হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে, দুঃস্বপ্ন তাড়া করে– কারা যেন লোহার রড দিয়ে পাঁচিল ভেঙে ফেলছে, অথবা উন্মত্ত জনতা দরজা ভাঙছে। 31
অগাস্ট 1946-এর দাঙ্গায় কলকাতায় 5000-এর উপর মানুষ মারা গেল। অক্টোবরে জ্বলে উঠল পূর্ববঙ্গের নোয়াখালি। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ছে আমেদাবাদে, মুম্বাইয়ে। সাভারকর টের পাচ্ছেন দেশভাগ আর ঠেকানো যাবে না।
1947-এর 15 অগাস্ট; বোম্বাইয়ে সাভারকরের বাড়ির ছাদে দুটি পতাকা উড়ল– গেরুয়া এবং তেরঙ্গা। না, উনি অন্য অনেক গেরুয়াধারীর মত ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’ বলেননি। তবে বলেছেন যে, এই স্বাধীনতা এসেছে বহু সহিংস পন্থার বিপ্লবী ও শহীদদের আত্মত্যাগের ফলে, আদৌ অহিংস অসহযোগের ফলে নয়। 32
তথ্যসূত্র:
-------------------------------------------
1 রীড এন্ড ফিশার; “দ্য প্রাউডেস্ট ডে”, পৃঃ 328
2 সাভারকর; “হোয়ার্লউইন্ড প্রোপাগান্ডা” পৃঃ 157-68
3 সাভারকর; “হোয়ার্লউইন্ড প্রোপাগান্ডা”, পৃঃ 50-51
4 রাঘবন; “ইন্ডিয়া’জ ওয়ার”, পৃঃ 15
5 সাভারকর, “হিন্দুরাষ্ট্র দর্শন”, পৃঃ 98-117
6 রাঘবন। “ইন্ডিয়া’জ ওয়ার”। পৃঃ 73-74
7 বম্বে ক্রনিকল, 15 জুন, 1941
8 বম্বে ক্রনিকল, 25 ডিসেম্বর, 1941
9 ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, 9 মার্চ, 1942
10 নিউ ইয়র্ক টাইমস, 8 এপ্রিল, 1942
11 পুরন্দরে; “সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব”, পৃঃ 264। উনি উদ্ধৃত করেছেন ‘ইন্ডিয়ান সামার’, পৃঃ 107-এ বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিতের বক্তব্যকে
12 ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, 19 অগাস্ট, 1942
13 বম্বে ক্রনিকল, 28 অগাস্ট, 1942
14 চার্চিলের এই বক্তৃতাটি ‘হিস্টোরিক হ্যান্সার্ড’ ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে ।
15 রামচন্দ্র গুহের ‘গান্ধী’, পৃঃ 684-85
16 আত্রে, “কড়েছে পানি”, খন্ড 3, পৃঃ 20-21
17 রথ এন্ড চ্যাটার্জি; “রাসবিহারী বসু”, পৃঃ 171-174
18 সুভাষচন্দ্র বোস, “টেস্টামেন্ট অফ সুভাষ বোস”, পৃঃ 21-24
19 সাভারকর; “হিন্দু রাষ্ট্র দর্শন”, পৃঃ 82
20 টাইমস অফ ইন্ডিয়া, 29 ডিসেম্বর, 1939
21 বম্বে ক্রনিকল, 29 ডিসেম্বর, 1939
22 নিকোলস; “ভার্ডিক্ট অন ইন্ডিয়া”, পৃঃ 184-185
23 মেহতা এন্ড পটবর্ধন; ‘দ্য কম্যুনাল ট্র্যাঙ্গেল ইন ইন্ডিয়া’, পৃঃ 178
24 আম্বেদকর; “পাকিস্তান”, পৃঃ 143
25 ঐ; পৃঃ 297
26 সীতারামাইয়া; “হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস”, খন্ড-৩, পৃঃ 542-43 এবং 529
27 “সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব”, পৃঃ 277
28 এম এস এম শর্মা; “পীপস ইন্টু পাকিস্তান”, পৃঃ 109-10; পাটনা, পুস্তক ভান্ডার, 1954
29 জিন্না; “সাম রিসেন্ট স্পীচেস এন্ড রাইটিং”, পৃঃ 308-309
30 পুরন্দরে; “সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব”, পৃঃ 292
31 ধনঞ্জয় কীর; “বীর সাভারকর”, পৃঃ ৩৭১; এবং গোখলে, “স্বতন্ত্রবীর সাভারকর”,পৃঃ 56-57
32 সাভারকর; “ঐতিহাসিক নিবেদনয়ে”, পৃঃ 161-163