১৯০৬ সালের মাঝামাঝি সাভারকর লন্ডনে গ্রে'স ইন এ ব্যারিস্টারি পড়তে এলেন। এর আগে পুনের ফার্গুসন কলেজে আইন পড়ার সময় তিনি বিদেশি বস্ত্র পোড়ানোর ডাক দিয়ে ছাত্র আন্দোলন করে শাস্তি পেয়েছেন।
তিলকের সুপারিশে সাভারকর ঠাঁই পেলেন লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউস হোস্টেলে। যার মালিক ছিলেন শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা, বিশিষ্ট ভারতীয় বিপ্লবী। উনি ইন্ডিয়ান সোসিওলজিস্ট বলে একটি র্যাডিক্যাল পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। 1
সেখানে যোগাযোগ হল বীরেন চট্টো (সরোজিনী নাইডুর ছোট এবং পরবর্তী কালের কমিউনিস্ট এম পি এবং কবি হারীন্দ্রনাথ চট্টোর বড়ভাই), বিপিন পালের ছেলে নিরঞ্জন এদের সঙ্গে। অচিরেই সাভারকর এখানে ছাত্রদের নেতা হয়ে উঠলেন।
ইন্ডিয়া হাউসের কার্যকলাপ নিয়ে লন্ডন টাইমস সমালোচনা করল এবং গোয়েন্দারা নজর রাখতে লাগল।
এমন সময় পুনেতে বিপ্লবী কবিতা প্রকাশনের অপরাধে ওঁর বড়দা এবং পরিবারের কর্তা বাবারাও সাভারকরের যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা হল। এর ঠিক ২৩ দিন পরে ১ জুলাই ১৯০৯ তারিখে লন্ডনে ইন্ডিয়া হাউসের সাভারকর গ্রুপের মদনলাল ধিঙড়া বৃটিশ প্রশাসক মর্লি'র এডিকং উইলিকে হত্যা করলেন। 2
পুলিশ ইন্ডিয়া হাউসে তালা ঝোলাল। 3
গ্রুপের অন্য তিন সদস্য বাপট, হোরিলাল এবং হেমচন্দ্র দাস বোমা তৈরির রাশিয়ান ম্যানুয়ালের ইংরেজি অনুবাদের কয়েক কপি নিয়ে ভারতে ফিরে গেলেন। পরে আলিপুর বোমার মামলায় (১৯০৯) হোরিলাল ও হেমচন্দ্র অভিযুক্ত হলেন। 4
সাভারকরের অপরাধ:
• ১৯০৮ সালে সাভারকর ভারতে কুড়িটি ব্রাউনিং পিস্তল লন্ডন থেকে ইন্ডিয়া হাউসের রাঁধুনি চতুর্ভূজ আমিনের মাধ্যমে ভারতে পাঠিয়েছিলেন।
• ২১ ডিসেম্বর, ১৯০৯। নাসিক শহরের ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে একটি থিয়েটার হলে গুলি করে মারা হয়। উনিই সাভারকরের দাদা বাবুরাওকে রাষ্ট্রদ্রোহের কবিতা ছাপার অপরাধে আজীবন কারাবাসের শাস্তি দিয়েছিলেন। 5
• সন্দেহ করা হয় যে হত্যার পেছনে আসল মাথা হচ্ছে লন্ডনে বসে বদলা নিতে কলকাঠি নাড়া ছোটভাই বিনায়ক দামোদর সাভারকর। চতুর্ভূজ আমিন রাজসাক্ষী হোল। সাভারকর লন্ডন ছেড়ে প্যারিসে গেলেন। হঠাৎ উনি প্যারিসের মাদাম কামার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সবাইকে অবাক করে লন্ডনে ফিরে গেলেন এবং ১৩ মার্চ ১৯১০ তারিখে ভিক্টোরিয়া রেল স্টেশনে নামামাত্র গ্রেফতার হলেন।
কেন?
এ নিয়ে অনেকগুলো থিওরি প্রচলিত।
যেমন দলকে উজ্জীবিত করতে বা নিজের সাহস প্রমাণ করতে, কারণ দলের মধ্যে কথা উঠছিল যে উনি সবাইকে ফিল্ডে অ্যাকশনে এগিয়ে দেন, কিন্তু নিজে নিরাপদে পেছনে থাকেন।
তবে আর একটা ইন্টারেস্টিং থিওরি বৃটিশ প্রেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে । তাহল উনি মার্গারেট লরেন্স নামে এক ইংরেজ মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁর গোপন আমন্ত্রণে দেখা করতে গিয়ে পুলিশের ফাঁদে বন্দী হন।
কৃষ্ণবর্মা প্রেসে চিঠি লিখে জানিয়েদেন যে, এটা পুলিশের দ্বারা প্রেমিকার বকলমে পাঠানো জাল চিঠি পেয়ে উনি ধরা পড়েন তা গুজব মাত্র। 6
(আমার মনে পড়ে সমারসেট মম'এর ছোটগল্পের দ্বিতীয় ভল্যুমে অ্যাশেন্ডেন সিরিজের ওই গল্পটি যাতে চন্দ্র নামের পাগড়ি পরা ভারতীয় বিপ্লবীকে বৃটিশ পুলিশ প্রেমিকার চিঠি পাঠিয়ে বন্দী করে।)
সাভারকরের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ, রাজদ্রোহ, ভারতকে মুক্ত করার ষড়যন্ত্র, জ্যাকসন হত্যায় অস্ত্র সরবরাহ, লন্ডনে বসে যুদ্ধের জন্যে অস্ত্র সংগ্রহ এবং ভারতে (১৯০৬) ও লন্ডনে (১৯০৮) বিদ্রোহের উদ্দেশে উস্কানিমূলক বক্তৃতা।
বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট রায় দিলেন যে এই বন্দীর ভারতে ফিউজিটিভ অফেন্ডার্স অ্যাক্ট ১৮৮১ অনুযায়ী বিচার হওয়া উচিত। 7
বৃটিশ রাজ সাভারকরের ভারতে বিচারের জন্যে এক তিন সদস্যীয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করল যাতে জুরি থাকবে না এবং যার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে না। 8
১ জুলাই ১৯১০-এ মুম্বাইগামী এস এস মোরিয়া জাহাজে একটি চারবার্থের কেবিনে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় সাভারকরকে তোলা হোল। 9
জাহাজ ৭ জুলাই সকাল ১০টায় ফ্রান্সের মার্সাই বন্দরে নোঙর ফেলল।
৮ জুলাই সকাল সাড়ে ছ'টায় সাভারকর পায়খানায় গেলেন। খানিকক্ষণ পরে কোন সাড়াশব্দ না পাওয়ায় বাকিরা এসে দরজা ভেঙে যখন ঢুকল তখন ছোট্ট পোর্ট হোলের মাঝখান দিয়ে সাভারকর পুরো গলে গিয়ে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। পুলিশের বিবরণ অনুযায়ী প্রায় ১২ ফুট সাঁতরে উনি জেটিতে উঠে দৌড়ুতে লাগলেন এবং ভারতীয় পুলিশ ও একজন ফ্রেঞ্চ ন্যাভাল সিকিউরিটি গার্ড ওঁকে চেপে ধরল।
বন্দী সাভারকরকে আবার ওই "মোরিয়া' জাহাজে তোলা হোল। 10
কার্ল মার্ক্সের নাতি তথা ল্যুমানিতের কলামনিস্ট জাঁ লঙ্গে সাভারকরের গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। 11
বিভিন্ন ফ্রেঞ্চ মিডিয়া যেমন- ল্যুমানিতে, লিব্রে প্যারোল, সান্ধ্য টেম্প তথা জুর্নাল দ্য দেবাত-এর মতো পত্রিকা বিদেশমন্ত্রীর উপর চাপ দিতে লাগল সাভারকরকে ফিরিয়ে আনতে।
মুম্বাইয়ের গভর্নর লর্ড সিডেনহ্যাম লিখলেন, "সাভারকর ওয়জ ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস মেন দ্যাট ইন্ডিয়া হ্যাজ প্রডিউসড'। 12
বৃটেনে বামপন্থীরা জোট বেঁধে সাভারকরের পক্ষে দাঁড়িয়ে "রিলীজ সাভারকর কমিটি' বানিয়ে প্রচার অভিযানে নাবলেন। ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান লিখল ফ্রান্সের মাটিতে পা রাখা মাত্র সাভারকরকে বৃটিশ আইনের ক্ষেত্রাধিকার থেকে মুক্ত মেনে নেওয়া উচিত। 13
শেষে ফ্রেঞ্চ সরকার এ নিয়ে মধ্যস্থতা চেয়ে দি হেগ এ আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে গেল। বৃটিশ রাজি হল, কিন্তু চাল দিল যে মুম্বাই কোর্টে সাভারকর মামলার শুনানি শুরু হয়েছে, সেটা স্থগিত হবে না।
বিচার শেষ হোল অস্বাভাবিক দ্রুততায়। মুখ্য প্রসিকিউটর জার্ডিন(বডিলাইন বোলিঙ কুখ্যাত ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন ডগলাস জার্ডিনের বাবা) 14 আদালতকে জানালেন যে এই সাভারকরই হচ্ছে লন্ডনে ভারতীয় র্যাডিক্যালদের মাথা।
প্রথম মামলা রাষ্ট্রদ্রোহিতার (বিভিন্ন বক্তৃতা এবং লেখার ভিত্তিতে)-- রায় বেরোল ২৩ ডিসেম্বর ১৯১০। যাবজ্জীবন কারাবাস এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ। তখন এর মানে ছিল ২৫ বছর।
জ্যাকসন হত্যা মামলার রায় বেরোল ৩০ জানুয়ারি , ১৯১১। একই রায় --আজীবন কারাবাস, মানে ২৫ বছর সশ্রম জেল। 15
কিন্তু দুটো শাস্তি এক সঙ্গে (কনকারেন্টলি) চলবে না, হবে একের পরে এক (কঞ্জিকিউটিভলি)। ফলে মোট কারাবাস ৫০ বছর, ও দিকে সাভারকর তখন ২৮ বছরের যুবক এবং ভারতীয়দের গড় আয়ু তখন ছিল আশির কম। 16
কিন্তু হেগ আন্তর্জাতিক আদালতের রায় না আসা পর্য্যন্ত সাজা মুলতুবি থাকবে।
উপরের রায় বেরোনোর এক পক্ষকাল পরে দি হেগ এ পার্মানেন্ট কোর্ট অফ আর্বিট্রেশন এ সাভারকর প্রত্যর্পণ মামলা শুনানি শুরু হল এবং মাত্র ১০ দিনের মধ্যে রায় বেরোল।
রায়ে স্বীকার করা হল যে ফ্রান্সের মাটিতে (মার্সাই) যে ফরাসি পুলিশ অফিসার সাভারকরকে বন্দি করে বৃটিশ পুলিশের হাতে সঁপে দিলেন তাতে আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টতঃ লঙ্ঘিত হয়েছে। কিন্তু এর ফলে আদৌ বৃটিশ সরকারের উপর বন্দিকে ফ্রান্স সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় না। কারণ ভুল তো বিদেশি সরকারের প্রতিনিধি করেছে। সাভারকরকে আলাদা করে একটা ১৪ বাই ৮ ফুটের সেলে রাখা হল। পাহারায় তিনজন-- দুই বালুচ মুসলিম এবং একজন পাঠান। তাঁর স্নানের ব্যবস্থার সময়েও ওই পাহারা।
মন্টেগু—চেমসফোর্ড কন্সটিট্যুশনাল রিফর্মের (১৯১৯) মাথায় অনেক রাজবন্দীকে মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল "রয়্যাল অ্যামনেস্টি' বলে। একই রকম মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলেন বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র দাস এবং ভাই পরমানন্দ। কিন্তু "রিফর্মের পর সাংবিধানিক পথেই থাকবেন' আশ্বাসন সত্ত্বেও বৃটিশ সরকার সাভারকর ভাইদের বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাঁরা সম্রাজ্ঞীর মার্জনা পেলেন না।
গান্ধীজি ১৯২০-র মে মাসে ইয়ং ইন্ডিয়ায় লিখলেন, এত লোককে আম মাফি দেওয়া হল, শুধু এই দুই ভাই বাদ! ওরা ত বিপ্লবের পথ ছেড়ে রিফর্ম অ্যাক্টের হিসেবে কাজ করবে বলে কথা দিয়েছে। 17
বৃটিশ রাজ এপ্রিল ১৯২১-এ বোম্বে গভর্নরকে একমাসের মধ্যে আগের সিদ্ধান্তের রিভিউ করতে বলল। 18
অবশেষে, মে ১৯২১-এ দুই সাভারকর ভাইকে আন্দামান থেকে ভারতের জেলে নিয়ে আসা হল। ১৯২৪ সাল পর্য্যন্ত রত্নগিরি জেলায় নজরবন্দি থেকে ছাড়া পেলেন সাভারকর কিন্তু আরও আট বছর কোন রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল।
সাভারকরের প্রদর্শিত হিন্দুত্ব রাজনীতি পরবর্তীকালে কোনদিকে মোড় নিল, সে আলোচনা উঠে আসা অবশ্যম্ভাবি। কিন্তু ব্রিটিশের ট্রেটর বলে যে ব্যক্তিটি পরবর্তীকালে সুপ্রসিদ্ধ হয়ে রইলেন, তাঁকে সে সব তকমা থেকে মুক্ত করে নূতন করে চর্চা হলে ব্যক্তিটি ও তাঁর রাজনীতি সুস্পষ্ট হবে।
--------------------------------------------------------------
তথ্যসূত্র:
1 “সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব”; পৃঃ ৭০-৭১।
2 ঐ; পৃঃ ৮২
3 ঐ; পৃঃ ৮৫।
4 ঐ; পৃঃ ৭৬-৭৭।
5 ঐ; পৃঃ ৯০।
6 “সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব”; পৃঃ ৯৫।
7 ঐ; পৃঃ ৯৯।
8 ঐ; পৃঃ ১০০।
9 ঐ; পৃঃ ১০৬।
10 ঐ; পৃঃ ১০৯।
11 ঐ; পৃঃ ১১০।
12 ঐ; পৃঃ ১১৩।
13 ঐ; পৃঃ ১১৫।
14 “সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব”; পৃঃ ১১৬।
15 ঐ; পৃঃ ১১৮।
16 ঐ; পৃঃ ১১৮।
17 ইয়ং ইন্ডিয়া,২৬ মে, ১৯২০; গান্ধীজির কলেক্টেড ওয়ার্কস,খন্ড ২০, পৃঃ ৩৬৮-৭১।
18 “সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব”, পৃঃ ১৬৫।