এত বর্ণময় নাগরিক মিছিল শেষ কবে দেখেছে, কলকাতা? মিছিলের অগ্রভাগে ভগৎ সিং-এর ছবি দেওয়া সুউচ্চ পতাকা। ক্লান্তিহীন কন্ঠে তরুণী স্লোগান দিচ্ছেন, ‘লালন সাঁইয়ের এই মাটিতে, বিজেপির ঠাঁই নেই।' যোগ্য সঙ্গত করছে সমবেত কন্ঠ, ‘ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই।' স্কটিশ চার্চের পড়ুয়া, বিদেশি গানের অনুকরণে র্যাপ বেঁধেছেন। তাঁর র্যাপে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তীব্র বিদ্রুপ করা হয়েছে। পিছন পিছন আসছেন চারজন যুবতী। তাঁদের হাতের পোস্টারে লেখা, ‘আমরা গড়িয়াহাটের নিচে থাকি, আমরাও বলছি বিজেপিকে একটিও ভোট নয়।'
10 মার্চের কলকাতা এমনই কিছু দৃশ্যের সাক্ষী রইল। সৌজন্যে ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’ মঞ্চের ‘কলকাতা চলো’ অভিযান। মৌলালির রামলীলা ময়দান থেকে শুরু হওয়া দীর্ঘ মিছিল শেষ হল কলকাতা কর্পোরেশনের সামনে। মিছিলে পা মেলালেন পাঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে আসা কৃষক আন্দোলনের নেতারা। অরাজনৈতিক মঞ্চের কর্মসূচিতে যে এত মানুষ সমবেত হবেন, তা উদ্যোক্তারাও ভাবতে পারেননি। মিছিল এগোতে থাকল তার মতো করে। মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির মিছিল কীভাবে এগোবে, কোন স্লোগান দেওয়া হবে— এই সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত থাকে। কিন্তু এই মিছিল নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক দলের ছিল না। উদ্যোক্তারা জানিয়েছিলেন, যারা বিজেপিকে ‘পথের লড়াইয়ে’ এবং ‘ভোটের লড়াইয়ে’ হারাতে চান, তাঁরা সকলে আসুন।
উদ্যোক্তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এলেনও অনেকে। অনেকে এই প্রথম কোনও মিছিলে হাঁটলেন। মিছিলে হাঁটল বোরখা, টপ-জিন্স, ধুতি পাঞ্জাবি, ছৌ মুখোশ। মিছিল থেকে দাবি উঠল বাংলায় বিভেদ নয়। মিছিল কিন্তু সত্যিই সব বিভেদ ঘোচাল। জনৈক বৃদ্ধা মিছিলে হাঁটছিলেন। গিয়ে আলাপ করা গেল এই বলে যে, করোনাকালে মিছিলে এলেন কেন? সপাটে উত্তর এল, "গ্যাসের দাম 900 টাকা করেছে, কেন্দ্রীয় সরকার। এদের এবার শিক্ষা দিতে হবে।'
মিছিল থামল তার গন্তব্যে, এলিট সিনেমা হলের সামনে। মঞ্চে একে একে বক্তব্য রাখলেন মঞ্চের উদ্যোক্তা এবং আহ্বায়করা— কুশল দেবনাথ, শামিম আহমেদ, অনিকেত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখরা। পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তাঁদের বক্তব্যে তুলে ধরলেন, তাঁদের সংগ্রাম এবং আপসহীনতার কথা। তাঁরা বললেন, ‘বাংলার আসন্ন নির্বাচন আসলে নয়া তিন কৃষি আইন নিয়ে গণভোটের চেহারা নেবে।' সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে তাঁরা বলেন, ‘আপনারা কি চান কর্পোরেটদের সহায়তার জন্য তৈরি করা এই কৃষি আইন বলবৎ হোক?’ উপস্থিত জনসমুদ্র সমস্বরে জানান দেয়, ‘না’। বৃদ্ধ কৃষক নেতা যুদ্ধজয়ের ভঙ্গিতে বলেন, ‘তবে শপথ করুন, বিজেপিকে একটা ভোটও দেবেন না।' হাততালিতে ভরে ওঠে সভাস্থল।
বক্তব্য রাখতে উঠে সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘বিজেপিতে যোগ দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত অভিনেতা বলছেন, এক ছোবলে ছবি। যারা অতীতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের বোঝান যে বিজেপি মানে বাংলায় বিষাক্ত ছোবল।' অনিকেত চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেক বক্তার বক্তব্যে উঠে আসে, বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের ‘বিপজ্জনক’ রাজনীতির কথা। তাঁরা বলেন, ‘আগে কংগ্রেস, মাঝে বাম আর এখন তৃণমূল— এদের অনেক অপশাসন, স্বৈরাচারী মনোভাব থাকলেও, বিজেপির মতো বিপজ্জনক দল আর কোনও দল নয়।' শ্রোতাদের মধ্যে থেকে মুষ্টিবদ্ধ হাতে মুহুর্মুহু স্লোগান ওঠে, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘কিসান ঐক্য জিন্দাবাদ’, ‘বিজেপিকে একটিও ভোট নয়’।
সভা শেষ হয় জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। ব্যস্ত ধর্মতলা তখন খানিক শান্ত। সভাস্থল ছাড়ার সময় দেখলাম, পাঞ্জাব থেকে আসা আন্দোলনকারী কৃষকের একরত্তি সন্তান কৃষক সংগঠনের সুউচ্চ হলুদ পতাকাটাকে তার ছোট পাঁচটা আঙুল দিয়ে আঁকড়ে আছে। একটু এগিয়ে হগ মার্কেটের কাছে ধনুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বছর দশেকের কিশোর। কাকে মারবি রে? শেখানো বুলির মতোই সে বলে ওঠে, ‘যারা মিলমিশ করে থাকে না, সবকিছুতে ভাগাভাগি করে তাদের।' মিলিয়ে যাচ্ছে স্লোগান, তবু মুষ্টিবদ্ধ হাতে, আগামীর জন্য চোয়াল শক্ত করতে শিখছে আরও কিছু আগামী। পথের আন্দোলন প্রত্যয়ী করছে জনতাকে, শাসককে করছে ভীত।