4thPillar


বাপের জম্মে এমন ভোট দেখিনি বাপু!!

সুদীপ্ত সেনগুপ্ত | 17-02-2021May 26, 2023
বাপের জম্মে এমন ভোট দেখিনি বাপু!!

বিধানসভা ভোটের আগে এবার পশ্চিমবঙ্গে দু’টো বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। এক, ঈশ্বরচন্দ্রবাবু নিজে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করলেও সার্জারির জন্য তাঁকে যদি সরকারি হাসপাতালে যেতে হয়, তবে তাঁর স্বাস্থ্যসাথী কার্ড গ্রাহ্য হবে তো? আর দুই, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তো তেমন আয় কিছু নেই, কলকাতায় আসলে হাওড়া থেকে জোড়াসাঁকো যেতে গাড়িই ভরসা; যেভাবে পেট্রোলের দাম বাড়ছে রবীন্দ্রনাথবাবুকে কি বুড়ো বয়সে হেঁটেই বাড়ি যেতে হবে?

 

বহু যুগ আগে মঞ্চে নারীর অভাবে যেমন স্ত্রীভূমিকা বর্জিত নাটক অভিনীত হত, এটাও তেমন রাজনীতি-ভূমিকা বর্জিত রাজনৈতিক প্রহসন। Millennials-রা (মিলেনিয়ালরা) এবারই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটে ভোট দেবে। তারা যথার্থই বলতে পারে, বলছেও হয়তো, বাপের জম্মে এখন ইলেকশন দেখিনি!

 

মিলেনিয়াল সহস্রাব্দের সন্তান, একবিংশ শতাব্দীরও বলা যেতে পারে। যাদের জন্ম 2000 সাল বা তার পরে। তাদের বয়স এখন সর্বোচ্চ 21, আগের বিধানসভা ভোটের সময়ে 2016 সালে তারা নাবালক ছিল। জন্মের সময়ে তার বাপের বয়স যদি 30 হয়, তবে আগের প্রজন্মের সেই ভোটারের জন্ম 1970 সালে। যৌন চেতনা জাগরণের পর মোটামুটি 15-16 বছরে সচেতন মানুষের রাজনৈতিক বোধ জন্মায় বলে ধরা হয়। সেই বিচারে ওই বাপের দেখা প্রথম পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন হল 1987 সালের ভোট। ওই বছর থেকে শুরু করলে রাজ্যে সাতটি বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে, অষ্টমটি আসন্ন। আগের সাতটি খুঁটিয়ে দেখে মিলেনিয়াল মেয়েটি বলতেই পারে, বাপের জম্মে এমন ভোট দেখিনি বাপু!!

 

তার কারণ, ওই 1987 থেকে শুরু করে 34 বছরে বঙ্গবাসী কখনও এমন অরাজনৈতিক নির্বাচন দেখেনি, যা এবার ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে এবং প্রবলতরভাবে ভোট পর্যন্ত দেখা যাবে বলে নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়।

 

1987 বামফ্রন্ট সরকারের 10 বছর পূর্ণ হয়েছে, পঞ্চায়েতি রাজ প্রতিষ্ঠা এবং ভূমি সংস্কারের ফলে গ্রামের জীবনে গুণগত এবং ভাবনাগত পরিবর্তন এসেছে। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর 1984 সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃ্ত্বে কংগ্রেস লোকসভায় 404টি আসন এবং 49 শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে। জ্যোতি বসুকে অবসরে পাঠানোর সঙ্কল্প ঘোষণা করেছেন রাজীব। প্রবল পরাক্রান্ত কংগ্রেসের আধিপত্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে জ্যোতি বসু, ফারুক আবদুল্লা, রামকৃষ্ণ হেগড়ে, বিজুপট্টনায়ক, এনটি রামা রাও প্রমুখ আঞ্চলিক নেতারা একত্র হচ্ছেন। কথায় কথায় কেন্দ্র রাজ্য সরকারগুলিকে বরখাস্ত করতে পারে কিনা, সংবধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মধ্যে রাজ্যের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ও মর্যাদা কতটা ইত্যাদি প্রশ্নে সারকারিয়া কমিশন কাজ করছে। কিন্তু তখনও রিপোর্ট দেয়নি। রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা (কল্পিত অথবা বাস্তবিক) রাজনীতিতে প্রবলভাবে আলোচিত হচ্ছে। এই ছিল মিলেনিয়ালের বাপের দেখা প্রথম রাজ্য বিধানসভা ভোটের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। যে যেভাবেই ভাবুক, যে যে পক্ষেই হোক, গুরুতর রাজনৈতিক ইস্যু হল রাজ্যের সাংবিধানিক স্বাধিকার।

 

1991 দু’ বছর আগে বোফর্স কেলেঙ্কারি ইস্যুতে রাজীবের কংগ্রেসকে পর্যুদস্ত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ। স্বল্পকালীন শাসনে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট কার্যকর করে (তফশিলি জাতি উপজাতি ছাড়াও অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণ গ্রহণ করে) তিনি ভারতীয় রাজনীতির চরিত্রটিই বদলে দিয়েছেন। তাঁর উত্তরসূরী চন্দ্রশেখর বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে দেশের সোনা বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছেন, সেই সময় দেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার 1.06 শতাংশ। কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে সেই সরকার ফেলে দিল কেন্দ্রে। রাজ্যে বামফ্রন্টের ততদিনে আর কেন্দ্রের সরকারকে বরখাস্ত করার আশঙ্কা নেই। আত্মবিশ্বাসীবামফ্রন্ট মেয়াদ ফুরনোর এক বছর আগে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভা ভেঙে দিয়ে ভোটে চলে গেল। সারা বিশ্বে একের পর এক কমিউনিস্ট সরকারের পতন হচ্ছে, বার্লিন ওয়াল ভেঙে পড়েছে। রাজ্যে বিরোধীদের দিক থেকে এখানেও কমিউনিস্ট শাসনের অবসানের আহ্বান। উল্টোদিকে গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যে থেকে বাম শাসন চলতে পারে কিনা সেই চ্যালেঞ্জ। আপনার বিচার যাই হোক না কেন, গুরুতর একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন সেবারের নির্বাচনে ছিল, তা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না।  

 

1996 কেন্দ্রে 5 বছর রাজত্ব করেছে পিভি নরসিংহ রাওয়ের সরকারতাঁর অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্র আমূল বদলে দিয়েছেন। লাইসেন্স রাজ ইতিহাসবাজারমুখী মুক্ত বাণিজ্য অর্থনীতি গ্রহণ করেছে দেশ। পাঁচ বছর আগে 1.06 থেকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার পৌঁছেছে 7.55 শতাংশে। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার দেরিতে হলেও অর্থনীতির দিক থেকে তার সাফল্য অনুধাবন করেছেরাজ্যে শিল্প আনার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছেসোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিছুটা বাধ্য হয়েই কৃষি এবং গ্রামের বাইরে তাকানোর দরকার বুঝতে পেরেছে বামফ্রন্ট। নির্বাচনের দুর্নীতি মাত্রা ছাড়িয়েছেদলের শাসন প্রশাসনকে ছাপিয়ে যাচ্ছেথানার বদলে পার্টির লোকাল কমিটি ক্রমশ বিবাদ নিষ্পত্তির শেষ জায়গা হয়ে উঠছে। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আছেকিন্তু কেন্দ্র ছন্নছাড়া কংগ্রেস রাজ্যে ততটা বাম বিরোধী হতে পারছে না। এই প্রেক্ষাপটে 79 বছরের জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে আবার বামফ্রন্ট নির্বাচনে গেল। যার যাই বিচারধারা হোক না কেনকোন রাজনীতি অর্থনীতিকে সহস্রাব্দের গোড়ায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রশ্নটি ছিল সেই ভোটের বিষয়

 

2001 দুই দশকের বেশি লাগাতার বাম শাসন ক্রমশ সিপিএম-এর একদলীয় শাসন হয়ে উঠছিল। জ্যোতি বসুর অবসরের পর অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছে বামফ্রন্ট। দিশাহীন নেতৃত্বের কংগ্রেস ভেঙে রাজ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে লড়াকু এবং পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস। সেই দল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হতে যাচ্ছে, তা পরিষ্কার। কংগ্রেসের মতো বাম সমর্থন নিয়ে কেন্দ্র সরকার বাঁচানোর দায়বদ্ধতা তার নেই। একটা আঞ্চলিক দল হিসেবে সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা তার একমাত্র ঘোষিত লক্ষ্য। ‘বাম অপশাসনের অবসান চাই‘ আওয়াজ তুলে ভোট লড়ছেন মমতা। আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক আঞ্চলিক দলের রাজনীতির বিরুদ্ধে তথাকথিত সর্বভারতীয় এবং ভাবাদর্শভিত্তিক রাজনীতির লড়াই এইভাবে নিজেদের দেখছে বামেরা। মিলেনিয়ালের জন্মের পর তার বাপের দেখা প্রথম বিধানসভা নির্বাচনটা ছিল এই রকম

 

2006 দল হিসেবে সিপিএম প্রায় পুরোপুরি পুলিশ এবং প্রশাসন নির্ভর হয়ে পড়েছে। এদিকে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার 8.06 শতাংশপরিষেবা এবং আইটি সেক্টরের প্রভূত অগ্রগতি হয়েছে। সাবেকি বামপন্থী ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করে শিল্প এবং শহরের দিকে নজর দিতে হবে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ‘ এই স্লোগান দিয়ে ভোটে গেল বামফ্রন্ট। সিপিএমের দলতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণ ধরেছে এবং বিরোধীদের সেটাই রাজনৈতিক ইস্যু। একটি কমিউনিস্ট দল ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে থেকে চিনের মতো পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথ গ্রহণ করতে পারে কিএই অতি গভীর গুরুতর রাজনৈতিক প্রশ্নটিই 2006 নির্বাচনে ছিল বিচার্য বিষয়। ভোটের ফল বের হওয়ার অব্যবহিত পর রতন টাটা রাইটার্স বিল্ডিংসে এসে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করে টাটা মোটরসের গাড়ি তৈরির কারখানা প্রস্তাব দেবেনএবং বামফ্রন্টের ভাগ্যের চাকা অচিরেই পুরোপুরি উল্টো দিকে ঘুরে যাবে। কিন্তু সেটা ভোট-পরবর্তী বিষয়

 

2011 সিঙ্গুরে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার, কারখানা তৈরির জোর আর দেখাতে পারল না। অন্যদিকে নন্দীগ্রামে বাম বিরোধী সমস্ত শক্তি একত্র হল। আন্দোলন দমন করতে সরকারের হাতে পুলিশছাড়া আর কিছু ছিল না। রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বামফ্রন্ট সম্পূর্ণ দেউলিয়া। শহুরে মধ্যবিত্ত, শিক্ষার উপর ভরসা করে বেঁচে থাকা সমাজও বামফ্রন্টকে পরিত্যাগ করল। শেষ দুই বছর সম্পূর্ণ পঙ্গুত্বে ভোগা বামফ্রন্টের বিদায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট গণনা শেষ হওয়ার অপেক্ষা মাত্র। 34 বছরে বামফ্রন্ট শাসনের অবসান কার্যত হয়ে গিয়েছিল ভোটের দুই বছর আগেই।

 

2016 পাঁচ বছর আগে ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার সম্পর্কে বাঙালির মিলেনিয়ালের বাপের আমল থেকে ধ্যান-ধারণা আমূল বদলে দিয়েছেন। সরকারের সদর দফতরটাই নদী পেরিয়ে হাওড়ায় চলে গিয়েছে কলকাতা ছেড়ে। মুখ্যমন্ত্রী ঘুরে বেড়ান সারা রাজ্যে, জেলায় জেলায় গিয়ে সরকার পরিচালনা করেন, নিজেই নতুন ট্যুরিস্ট স্পট আবিষ্কার করে তার জন্য ব্যয় বরাদ্দ করেন। অনেকেই মনে করছেন আঁতলামো ছেড়ে সরকার সাধারণ মানুষের কাছে এসেছে, সরকারি স্বীকৃতি পাচ্ছেন জনপ্রিয় মানুষরা। সরকারের কাজকর্মে সড়ক যোগাযোগ, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং পুর পরিষেবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চোখে পড়ার মতো উন্নতি হয়েছে বামফ্রন্ট আমলের তুলনায়। মিলেনিয়ামের বোধবুদ্ধি হওয়ার পর প্রথম এবং তার বাপের দেখা সপ্তম বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রত্যাবর্তন অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না। কিন্তু ততদিনে দিল্লিতে এসে গিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। বাম রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হতে শুরু করেছে। রাজ্যভিত্তিক আঞ্চলিক দলের রাজনীতি বিজেপির আগ্রাসী উগ্র জাতীয়তাবাদী বিভাজনবাদী রাজনীতির প্রতিস্পর্ধী হতে পারে কি? সর্বশেষ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে এটাই ছিল আসল রাজনৈতিক প্রশ্ন। কিছুটা নিরুচ্চারে হলেও।

 

2021 কে নেবে বাংলার দখল? পিসি-ভাইপো থেকে বাপ-বেটা, কার দুর্নীতি কত বড়? বাঁডুজ্জে পরিবার নাকি শাহ-তন্ত্র? কাকে কোন সরকারি এজেন্সি দিয়ে ধমক-চমক দেওয়ানো যায়? মিথ্যাকে সোশাল মিডিয়ার সুবাদে কতদূর প্রসারিত করা যায়? পাবলিককে কত বড় আহাম্মক ভাবা যায়?

 

মিলেনিয়াল ভোট দিতে গিয়ে বলতেই পারেএগুলো কী? এরা কারা? কী চায়? আমাদের কাজের কথা কোথায়? খেত ছেড়ে রাজপথে বসে থাকা কৃষকের কথা কোথায়? নোট বাতিলে কাজ হারানো মানুষের রুটি-রুজির কথা কোথায়?



New
মাদক ব্যবসা ও বিভাজনের রাজনীতির আবর্তে আজকের মণিপুর
ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে রাষ্ট্রীয় মদত? বিস্ফোরক রিপোর্ট অসম রাইফেলসের
বিরোধী জোট আছে, রাজনীতি কই?


Other Writings by -সুদীপ্ত সেনগুপ্ত | 17-02-2021

// Event for pushed the video