4thPillar


কুয়াশার মধ্যে এক ছটাক রোদ্দুর বছরের শুরুতেই

রঞ্জন রায় | 03-01-2021May 26, 2023
কুয়াশার মধ্যে এক ছটাক রোদ্দুর বছরের শুরুতেই

বেলা এগারোটা। গুরগাঁওয়ে ঘন কুয়াশার মধ্যে মাত্র একটু রোদ্দুরের আভাস, তখনই খবরটা চোখে পড়ল। ভাবলাম নতুন বছরের গোড়ায় সবার সঙ্গে এই মন ভাল লাগাটা ভাগ করে নিই

 

খবরটা অসমের

 

গুয়াহাটি শহরের রিকশাওলা মহম্মদ নুর হুসেন (34 বছর), তাঁর স্ত্রী সহেরা বেগম (27 বছর) এবং দুটো বাচ্চাকে নিয়ে গত দেড় বছর জেলে ছিল। অপরাধ? ওরা নাকি বিদেশি অনুপ্রবেশকারী, বাংলাদেশ থেকে চুপচাপ বর্ডার পেরিয়ে ঢুকেছে। ফরেন ট্রাইব্যুনালের রায়ে ওরা জেলে ছিল। কিন্তু গত মাসে ওই ট্রাইব্যুনালেরই পুনর্বিচারের রায়ে সব পাল্টে গেল। প্রমাণ হল ওরা দস্তুরমত ভারতীয় নাগরিক। নুরের বক্তব্য, ‘আমি তো এ দেশেই জন্মেছি। আমরা অসমে আছি বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে। কেন আমাকে আগে বিদেশি বলল? মুসলমান বলে?’

 

ভাবতেই পারেন—আরে বাবা, ভুল হয়ে গেছে; শুধরে নিয়েছে ব্যস। এত কথা কেন?

 

তাহলে পুরো গল্পটা শুনুন

 

আজন্ম নিজভূমে থেকেও পরবাসী

অসমের উদলগিরি জেলার লাউডং গ্রামে জন্মানো মহম্মদ নুর হুসেনের ঠাকুরদার নাম 1951 সালের ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনে (এনআরসি) রয়েছে। ভারতে প্রথম বা একমাত্র এনআরসি হয়েছে অসমেই 1951 সালে, এবং তাতে ওর ঠাকুরদা ভারতীয় নাগরিক। ওর বাবা-মা এবং দাদুর নাম 1965 সালের ভোটার লিস্টে রয়েছে। ওর শ্বশুরের নামও যথাক্রমে 1951 সালের এনআরসি তালিকায় এবং 1965 সালের ভোটার লিস্টে রয়েছে। এ ছাড়া ওদের জমির কাগজপত্রও 1957-58 সালের। আর 1985 সালের রাজীব গান্ধী সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত অসম চুক্তি অনুযায়ী অসমের নাগরিকতা তারা পাবে যারা 1971 সালের 25 মার্চের আগে থেকে অসমে বসবাস করছে। কারণ, 1971 সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় খানসেনাদের অত্যাচারে অনেক বাঙালী, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, সীমান্ত পেরিয়ে অসমে আশ্রয় নিয়েছিল

 

তাহলে এদের তো কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, পুরো খানদানের কাগজপত্র যাকে বলে একেবারে খাপেখাপ। কিন্তু 2017 সালে যখন অসম পুলিশের বর্ডার পুলিশ বিভাগ এই রিকশাওয়ালা দম্পত্তির নাগরিকত্বের প্রমাণ নিয়ে তদন্তে নামল, তখন এই সব কাগজপত্র কোনও কাজে এল না। পুলিশ সেই বছরের অগস্ট মাসে নুরের বৌয়ের কেস বানাল কামরূপ (মেট্রো) জেলার এফটি 4 বা ফরেন ট্রাইব্যুনাল-4-

 

জানুয়ারি 2018 সালে নুর হুসেনেরও সেই হাল হল

 

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নুর হুসেন জানিয়েছে, ওরা লেখাপড়া জানে না, তাই ওদের যে কাগজ ধরিয়ে দেয়া হল তার তাৎপর্য ওরা বোঝেনি এবং এর পর কী করতে হবে তাও জানত না[1]

 

ওদের ফরেন ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির হয়ে নিজেদের নাগরিকতার প্রমাণ যুক্তি দিয়ে পেশ করতে বলা হল

 

ট্রাইব্যুনালে নুর নিজের জন্যে 4000 টাকা খরচ করে উকিল নিযুক্ত করেছিল। সেই উকিল 2018-এর 28 অগস্ট শুনানিতে যাওয়ার পর ওকে —তুই আর খরচা দিতে পারবি না, বলে হাত ঝেড়ে ফেলল। উল্টে পরামর্শ দিয়ে গেল, তুই এবার গুয়াহাটি থেকে পালা, নইলে পুলিশ গ্রেফতার করবে। কিন্তু নুর বলল, কেন পালাব? আমি তো কোনও অপরাধ করিনি!

 

নুর আর পরের শুনানিগুলোতে হাজির হতে পারেনি। ওর বৌ সহেরা বেগম উকিল ছাড়াই ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে গেল। 2018 সালের 29 মে ফরেন ট্রাইব্যুনাল সহেরা বেগমকে ‘বিদেশী’ ঘোষণা করল। 2019 সালের মার্চ 30শে নুরের কপালেও জুটল বিদেশি’ তকমা

 

ফরেন ট্রাইব্যুনাল হল একটি কোয়াসি-জুডিশিয়াল বা আধা-ন্যায়িক প্রতিষ্ঠান। এদের দায়িত্ব হল ‘বেআইনি বিদেশি’দের চিহ্নিত করা। এরা পুলিশি তদন্তে যাদের নাগরিকত্ব সন্দেহজনক মনে হয়েছে অথবা ইলেকশন কমিশনের চোখে যারা ‘ডাউটফুল’ বা সন্দেহজনক ভোটার, তাদের কেস পরীক্ষা করে রায় দেয় যে ওরা খাঁটি ভারতীয় নাকি বেআইনি ভাবে ঢুকে পড়া বিদেশি

 

অভিযুক্তকেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে

এখন ফরেন ট্রাইব্যুনাল আইনের ধারা 9 অনুযায়ী তুমি যে বিদেশি নও বরং খাঁটি এদেশের নাগরিক, সেটা তোমাকেই প্রমাণ করতে হবে। যে অভিযোগকর্তা, মানে বর্ডার পুলিশ বা নির্বাচন কমিশন, তার কোনও দায় নেই অভিযোগ প্রমাণ করার। তারা তোমার দিকে আঙুল তুলেই খালাস। ফলে অভিযুক্ত যদি একের পর এক শুনানিতে গরহাজির থাকে তাহলে ট্রাইব্যুনাল একতরফা রায় দিতে পারেএই দম্পতির ক্ষেত্রে তাই হল

 

ট্রাইব্যুনাল এদের বাংলাদেশ থেকে বেআইনি ভাবে অসমে ঢুকে পড়ার অপরাধে দোষী ঘোষণা করল। কথা ছিল, চিহ্নিত বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের তাদের মূল ভূখণ্ডে ফেরত পাঠানো হবে, সম্ভব না হলে, ডিটেনশন ক্যাম্পে- যা এক ধরনের জেল। তাই 2019-এর 29 জুন যখন ওদের দুজনকে গ্রেফতার করে গোয়ালপাড়ার ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানোর আদেশ এল, ওদের পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। বাচ্চা দুটো 5 আর 7 বছরের। কার কাছে রেখে যাবে? ওরা যুক্তি করে বড় ছেলে শাহজাহানকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনল; তার পর দুটো বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়েই ডিটেনশন সেন্টারে গেল। বাচ্চা দুটো খালি বাড়ি যাবার কথা বলে, বড়টা স্কুলে যেতে চায়

 

ওরা তো জেলে, কিন্তু খবর পেয়ে কিছু আত্মীয় গুয়াহাটিতে একজন মানবাধিকার আইনজীবী আমন ওয়াদুদের কাছে গেল। উনি, সৈয়দ বুরহানুর রহমান এবং জাকির হুসেন নামের দু’জন উকিলকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে গুয়াহাটি হাইকোর্ট এবং তার পর ফরেন ট্রাইব্যুনালের সামনে এই দম্পতির পক্ষের প্রমাণাদি নিয়ে দাঁড়ালেন। এ বছর 9 অক্টোবরে হাইকোর্ট ট্রাইব্যুনালের আগের রায় খারিজ করে আবার শুরু থেকে শুনানি করতে বললেন। পুনর্বিচার শুরু হল। ওরা নভেম্বরের শেষের দিকে জামিনে ছাড়া পেয়ে সপরিবার জেলের বাইরে পা রাখল। তারপর গত 16 ডিসেম্বর ফরেন ট্রাইব্যুনাল মহম্মদ নুরকে নির্দোষ ঘোষণা করল, আর গত পরশু সহেরা বেগমকে। এখন ওরা, মানে স্বামী-স্ত্রী এবং দুটো বাচ্চা ভারতের বৈধ নাগরিক। কিন্তু তার আগে ওদের প্রায় দেড় বছর জেলে থাকা? তার জন্যে কোনও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আমাদের আইনে নেই

 

সে দিন রাতে যখন ওরা তিনজন উকিলের সঙ্গে মিলে ওদের মুক্তি পাওয়া এবং ভারতের বৈধ নাগরিক হওয়ার ঘটনাটি সেলিব্রেট করছিল, তখন ওয়াদুদ সাহেব বড় ছেলে আট বছরের শাহজাহানকে জিজ্ঞেস করলেন—বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?

 

একটুও না ভেবে ছেলেটি বলে—উকিল

 

এই এক ঝলক রোদ্দুরের গল্পটি এখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মানবাধিকার কর্মী এবং গুয়াহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী ওয়াদুদ সাহেব বলেন, সবাই উকিল জোগাড় করতে পারে না, আদালতের খরচা চালাতে পারে না। ফলে বিদেশি হওয়ার মিথ্যা অভিযোগে জেল খাটে। এখন যারা বিদেশি বা বেআইনি অনুপ্রবেশকারী অভিযোগে জেলে আছে তাদের অনেকেই আসলে সময়মতো উকিল নিযুক্ত করতে পারেনি

 

মহম্মদ নুরেরাও পারেনি। ভাগ্যিস ওদের আত্মীয়স্বজনরা খবর পেয়ে সক্রিয় হয়েছিল

 

তাহলে কী দাঁড়াল? ফরেন ট্রাইব্যুনাল শেষমেশ কতজনকে বিদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত করল? গত 30 জুন, 2018 সালে অসম সরকার এনআরসির যে প্রথম তালিকা বের করে তাতে 330 লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় 40 লাখ লোক সন্দেহজনক বা বিদেশি বলে ঘোষণা করা হয়। অনেক হইচই আপত্তির পর সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত পর্যবেক্ষক প্রতীক হাজেলার অধীনে ফাইনাল লিস্ট বেরোয় 31 অগস্ট, 2019 তারিখে তাতে ইল্লিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট বা বেআইনি শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়াল 19 লাখের সামান্য বেশি[2] এর জন্যে সরকারের খরচ হয়েছে প্রায় 4000 কোটি টাকা

 

এরা এখন কী করবে? সুপ্রিম কোর্টের নিয়ম অনুযায়ী এরা 120 দিনের মধ্যে আপিল করতে পারে। সেই 120 দিন পূর্ণ হয়ে গেছে 31 ডিসেম্বর, 2019 তারিখে, অর্থাৎ একবছর আগে। স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে— ট্রাইব্যুনালের কাছে কত জনের আপিল এসেছে আর কতগুলোর নিষ্পত্তি হয়েছে? ওই 19 লাখের মধ্যে আপিল জমা হয়েছে 4 লাখের মত এবং ফয়সালা হয়েছে 2 লাখের

 

এনআরসি-তে বাদ পড়া 15 লাখ মানুষের কী হবে?

ঘোষণা অনুযায়ী ওরা যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফেরত পাঠানো হবে, নইলে জেলে[3] কিন্তু বাংলাদেশ সরকার জানিয়ে দিয়েছে ওরা কাউকে নেবে না কারণ যেভাবে ওদের চিহ্নিত করা হয়েছে তা থেকে আদৌ ওরা বাংলাদেশ থেকে গেছিল এমন প্রমাণ হয় না

 

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী 22 ডিসেম্বর দিল্লিতে এক জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার কোনও ডিটেনশন সেন্টার তৈরি করছে না। দেশজুড়ে কোনও এনআরসির পরিকল্পনা নেই,  সব হল আর্বান নকশালদের অপপ্রচার[4]

 

কিন্তু অসমের সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ জানিয়েছিলেন কথাটা অর্ধসত্য, কেন্দ্রীয় সরকার নিজে বানাচ্ছে না, কিন্তু টাকা দিয়ে রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দিচ্ছে। কেন্দ্রের 43 কোটি টাকায় অসমের গোয়ালপাড়ায় তৈরি হয়েছে ভারতের বৃহত্তম ডিটেনশন সেন্টার, চারতলা বাড়িতে প্রায় 900 বন্দি থাকবে। এছাড়া অসমে মোট দশটি ডিটেনশন সেন্টার রয়েছে[5]

 

আপনি ভাবতেই পারেন এ সব হল মুসলমানদের ব্যাপার, ওরা বুঝবে; শাহিনবাগের মত ধর্নায় বসবে। হ্যাঁ, অসম সরকার ধুবড়ি জেলার 10টি ফরেন ট্রাইব্যুনালের 7টিতে সরকারের মুসলিম উকিল বদলে দিয়েছে[6] আমরা হিন্দু, সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমাদের কীসের ভয়? ভাবতেই পারেন

 

ফরেনার্স ট্রাইবুন্যাল নাকি ক্যাঙারু কোর্ট?

2019শের সেপ্টেম্বরের একটি দিন। মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত দি ক্যারাভান পত্রিকার সাংবাদিক সাগর গুয়াহাটির উলুবারি পাড়ায় হাজির হলেন একটি ফরেন ট্রাইব্যুনালের শুনানি সরেজমিনে দেখবেন বলে। একটি প্রাইভেট বাড়ির খোলা বারান্দায় চারটে চেয়ার ও দুটো টেবিল লাগিয়ে চলছে শুনানি। সাংবাদিক ও আমজনতাকে পুলিশ ঢুকতে দিচ্ছে না, জায়গাও নেই। বাইরে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে অনিল, সঙ্গে সাত বছরের ছোট মেয়ে। শুনানি হচ্ছে ওর বৌ কল্পনার। ও নিজে গুয়াহাটির উপকণ্ঠে খেতরি এলাকার দিনমজুরি করে। মাত্র ক’দিন আগে পুলিশ এসে ওকে জানায় যে তোমার বৌয়ের নাম ডাউটফুল ভোটারের লিস্টে, অমুক দিন তমুক ট্রাইব্যুনালে শুনানি আছে। গিয়ে প্রমাণ কর যে ও বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নয়। নইলে আমরা ওকে জেলে পুরতে বাধ্য হব। 1997 এর ভোটার লিস্টে কল্পনার নাম রয়েছে। কবে যে ওর নামের পাশে D তকমা লেগে গেছে অনিল জানতেও পারেনি। এখন ওকে ঢুকতে দেওয়া হবেনা। যদি উকিল আনতে পারে তাহলে শুধু সেই ঢুকবে

 

কিন্তু তাতেই বা কী? ট্রাইব্যুনালের শুনানির সময় অভিযুক্তের উকিল তদন্তকারী অফিসারকে, মানে যিনি কাউকে ‘সন্দেহজনক’ বলে চিহ্নিত করেছেন তাকে, ক্রস এগজামিনেশন করতে পারবে না। কেন ? ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের যুক্তি হল --না, এই আইনে তো অভিযুক্তকেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। অভিযোগকারীকে কিছু প্রমাণ করতে হবে না

 

এভিডেন্স অ্যাক্টের একেবারে পিণ্ডদান হয়ে গেল

 

অরুণাচলের অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং গুয়াহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী নিলয় দত্ত যাই বলুন, সাংবাদিক সাগর তৃণমূলস্তরের সত্যিটা খুঁজতে অন্ততঃ দশটি ট্রাইব্যুনালে গিয়ে দেখেছেন, অন্ততঃ 24 জন উকিলের সঙ্গে কথা বলেছেন – মনে হয়েছে যেন ক্যাঙারু কোর্ট চলছে[7]

 

গন্ডগোলটা কোথায়? রাজনৈতিক ইচ্ছায়

 

কেন্দ্র ট্রাইব্যুনালের অফিসারদের নিজেরা নিযুক্ত না করে অসম সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে দায়িত্ব দিল। ওরা ট্রাইব্যুনালকে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে না দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা (যত পারো বাঙালিদের, হিন্দু বা মুসলিম, অসমে বহিরাগত বলে দাগিয়ে দাও) অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল। এঁরা দু’বছরের জন্যে নিযুক্ত হবেন, এঁদের ‘পারফরম্যান্স’ সন্তোষজনক না হলে এদের ফেরত পাঠানো হবে

 

ফলটা হল মারাত্মক। এদের কাজের সমীক্ষা করার ফর্মে রয়েছে একটা পয়েন্ট—তুমি কতজনকে ‘বিদেশি’ বলে দাগিয়ে দিয়েছ?

 

এটাই আসল কথা। এই দিয়েই ট্রাইব্যুনাল সদস্যদের কাজের ভ্যালুয়েশন হবে

 

এই উদাহরণটি দেখুনঃ

কার্তিক রায়চৌধুরী তাঁর কেসগুলোর মধ্যে 26% কেসের ফয়সালা করে দিয়েছেন, কিন্তু মাত্র একজনকে বিদেশি বলেও শনাক্ত করেছেন। ওনার কাজকম্ম ‘অসন্তোষজনক’, কাজেই চাকরি খারিজ। অথচ নারায়ণচন্দ্র নাথ মাত্র 15% কেসের ফয়সালা করেছেন, কিন্তু তার মধ্যে 34%কে বিদেশি বলে রায় দিয়েছেন। তাঁর কাজকম্ম ‘সন্তোষজনক’। কাজেই চাকরি বহাল[8]

 

2017 সালে এ ভাবে ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত 19 জন (যাদের মধ্যে প্রাক্তন জেলা জজ ও উকিল রয়েছেন) গুয়াহাটি হাইকোর্টে মামলা দায়ের করল। ওঁদের মূল বক্তব্য, যে সরকার চাইছে সত্যের বদলে কোনও না কোনও ভাবে মানুষজনকে ‘বিদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ঘোষিত করায়। আমরা যারা নিরপেক্ষ ভাবে আইনসম্মত পদ্ধতিতে সাক্ষ্য এবং ডকুমেন্টের ভিত্তিতে রায় দিচ্ছি কেবল তাদেরই বরখাস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু হাইকোর্ট সরকারের পক্ষে রায় দিয়ে বলল কোনও পক্ষপাত দেখছি না। কাজকর্ম ‘অসন্তোষজনক’, তাই বরখাস্ত[9]

 

সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত দুই বিচারপতি মদন বি লোকুর ও কুরিয়ান জোসেফ এবং দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ পি শাহ এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী জনতার অভিযোগ শোনার জন্যে পিপলস ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। সব শুনে এবং কাগজপত্র দেখে তাঁদের সর্বসম্মত রায় হল এই ফরেন ট্রাইব্যুনাল নিরপেক্ষ বিচারের বদলে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলছে[10]

 

এই ব্যাপারটার মধ্যে একটা ফাঁকি রয়েছে। 200 ট্রাইব্যুনালের জন্য ডেপুটেশনে নেওয়া হয়েছে স্কুল শিক্ষকদের এবং অন্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের। কারণ এই কাজের জন্যে আইনের কাণ্ডজ্ঞান ও অভিজ্ঞ লোক বেশি সংখ্যায় জোগাড় করা মুশকিল। আবার এই লক্ষ লক্ষ লোকের ভাগ্যনির্ধারণকারী বেঞ্চের সহায়ক হওয়ার জন্যেও সাধারণত আইনের ডিগ্রি দরকার। কিন্তু এখন 18 থেকে 43 বছরের মধ্যে কেউই আবেদন করতে পারেন, শিক্ষার ন্যূনতম যোগ্যতা হায়ার সেকেন্ডারি[11]

 

কিন্তু এত সব করে হল কী? ফাইনাল লিস্টে ঘোষিত 19 লাখ বাঙালি কথিত বহিরাগত বা বেআইনি শরণার্থীদের মধ্যে মাত্র 7 লাখ মুসলমান! বাকি 12 লাখ হিন্দু বাঙালি? গল্পটাই যে বদলে যাচ্ছে। তাই অসমের সরকার ও বিজেপি দলের বক্তব্য, এই ফাইনাল লিস্টেও ভুল আছে। আরও কড়া করে ছাঁটাই দরকার

 

এর প্রতিকার হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার এনেছে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা সিএএ। যার মোদ্দা কথা হল প্রতিবেশি মুসলিম দেশগুলো থেকে ডিসেম্বর 2014 সালের আগে যাঁরাই ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে বৈধ কাগজপত্র ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই ভারতে এসেছে, সবাইকে ভারতের নাগরিক বলে মেনে নেওয়া হবে। তাই বাদ পড়ে গেল বৌদ্ধ শ্রীলঙ্কা থেকে আসা হিন্দুরা, বৌদ্ধ মায়ানমার থেকে আসা মুসলমান রোহিঙ্গারা এবং ভুটান থেকে যদি কেউ আসে। অথচ মুসলিম আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলমানরা এই সুবিধে পাবে, যদিও ওদের সঙ্গে ভারতের কোনও সীমান্ত নেই। আফগানিস্তান ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল না, কিন্তু বার্মা (মায়ানমার) ছিল

 

নাগরিকত্বের নয়া জমানায় আমি নিজে কোথায়?

জন্মেছি স্বাধীন ভারতের কলকাতায় 1950 সালে। দেশের নাগরিকত্ব আইন 1955 হিসেবে আমি জন্মের সূত্রেই এ দেশের নাগরিক। আমার পড়াশোনা, চাকরি সব এখানে। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট সব আছে। কিন্তু বার্থ সার্টিফিকেট? নেই। সে কী, আসলটাই নেই?

 

কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে জন্মেছিলাম। তখন এ সবের চলন ছিল না

 

তাহলে তো মুশকিল। কারণ একজন সরকারি আমলা ব্যাখ্যা করেছেন আধার, ভোটার কার্ড পাসপোর্ট ইত্যাদি ভারতে বসবাসের প্রমাণ হলেও নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। [12] কী আশ্চর্য, এক বছর আগে যে বিজেপির সাসংদ দিলীপ ঘোষ মশাইও একই কথা বলেছিলেন—আধার কার্ড, ভোটার আইডি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়[13]

 

কিন্তু আমার বাবা ইন্ডিয়ান আর্মির সৈনিক ছিলেন, 1948 সালে কাশ্মীরে লড়তে গেছিলেন

 

ধেত্তেরি! তার কোনও প্রমাণ আছে? রেকর্ড? ডিসচার্জ সার্টিফিকেট?

 

কোনও দিন কি ভেবেছি বাবা মারা যাওয়ার 30 বছর পরে এ সব কাজে লাগবে?

 

এদিকে কারগিলের সৈনিকের মায় বর্ডারে বর্তমানে পাহারা দেওয়া সৈনিকের নাম গত বছর বিদেশি লিস্টে ছিল, দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের বংশের তৃতীয় প্রজন্মের সদস্যের নাম ভোটার লিস্টে কাটা পড়ছে তো এদিকে --!

 

আপনার বাবা-মা কোথায় জন্মেছিলেন? অবিভক্ত ভারতের ময়মনসিংহ জেলায়। ও পূর্ব পাকিস্তানে? কবে মা ভারতে এসেছিলেন? 1950 সালে আমার জন্মের আগে। মানে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে?

 

হ্যাঁ। কিন্ত আমি তো কলকাতায় জন্মেছি 1950 সালে, মানে স্বাধীন ভারতে। তবে সার্টিফিকেট নেই

 

আসল হল বার্থ সার্টিফিকেট অরিজিনাল, ঠিক আছে, হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার সার্টিফিকেট? তাতে তো জন্ম তারিখের উল্লেখ থাকে। অরিজিনাল আছে নিশ্চয়ই?

 

না, সার্টিফায়েড ট্রু কপি আছে

 

ফোটোকপি?

 

আজ্ঞে হাতে কপি করা

 

উফ, আপনার মশাই ডিটেনশন ক্যাম্পেই যাওয়া উচিত

 

নববর্ষের রোদের ঝিলিক আবার কুয়াশায় হারিয়ে গেছে

 

তথ্যসূত্র:

------------------------------

 

[1] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস; ১লা জানুয়ারি, ২০২১।

[2] বিজনেস টুডে, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯।

[3] দি হিন্দু, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯।

[4] হিন্দুস্থান টাইমস, ১৩ অগাস্ট, ২০২০।

[5] ঐ ।

[6] দি প্রিন্ট, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০।

[7] দি ক্যারাভান, ৬ নভেম্বর, ২০১৯।

[8] দি ক্যারাভান, ৬ নভেম্বর, ২০১৯।

[9] ঐ ।

[10] ঐ ।

[11]  দি সেন্টিনেল (আসাম), ৩০ নভেম্বর, ২০২০।

[12] নিউ ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ডটকম, ২১ ডসেম্বর, ২০১৯।

[13] হিন্দুস্থান টাইমস, ১৮ জানুয়ারি, ২০২০।


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -রঞ্জন রায় | 03-01-2021

// Event for pushed the video