4thPillar


প্রাসঙ্গিক অথচ উপেক্ষিত যে রবীন্দ্রনাথ

মৌনী মন্ডল | 07-08-2020May 25, 2023
প্রাসঙ্গিক অথচ উপেক্ষিত যে রবীন্দ্রনাথ

প্রাতিষ্ঠানিক, গতানুগতিক অথবা ‘এক্সপেরিমেন্টাল’... রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পৃথিবীব্যাপী চর্চায় কোনও ছেদ পড়েনি। মৃত্যুর আগে অথবা পরে নিজস্ব আলোর ছত্রছায়ায় এনেছেন বিশ্ববাসীকে, এ কথা আজ আর আনুষ্ঠানিকভাবে বলার প্রয়োজন পড়ে না। তবে, বাংলা এবং বাঙালি জাতিকে সর্বব্যাপী করে তোলার পথে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা অগ্রাহ্য করার নয় বলেই হয়তো বেশিরভাগ বাঙালি তাঁকে গভীরার্থে না উপলব্ধি করেই উন্মাদবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হন। তাঁকে নিয়ে পাগলামো করলে ভাল কিছুই ছড়িয়ে পড়বে, তা যেমন ঠিক, অন্যদিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ছড়িয়ে পড়াটা হয়ে ওঠে শুধুমাত্র ফাঁপা একটা অভ্যাসের মতো। গোটা কয়েক জনপ্রিয় গান, উপন্যাস, গল্প, ছড়া, কবিতা - যেসব নিয়ে মাতামাতি করে বাঙালি, তার বাইরে ব্যাপকার্থে যে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন, দুর্ভাগ্যবশত কস্মিনকালেও সেসবের চর্চা করেন না তাঁরা। এমন একটা ভাব, যেন তিনি ‘ঠাকুর’, এই যথেষ্ট।

দার্শনিকতায় তিনি কত শত মানিক্য-জহরত রেখে গিয়েছেন, যা অবহেলিত হয় সাধারণভাবে- অন্ধকারে থাকে, তা আলোয় আসা প্রয়োজন এই সময়ের নিরিখে, বিশেষত যে সময় মহামারি-লকডাউন উপেক্ষা করে দেশে ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার তুমুল চেষ্টা চলছে, রামমন্দির বানানো আর শিক্ষার উপযোগিতা গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। তাই ‘দেশ-শিক্ষা-উপায়’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে বিস্তৃত দর্শন গান-কবিতা-উপন্যাসের সঙ্গে, তাও যদি সর্বসাধারণের চিন্তায় জায়গা করে নেয় মন্দ কী!

‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “আমাদের প্রথম বয়সে ভারতমাতা, ভারতলক্ষী প্রভৃতি শব্দগুলি বৃহদায়তন লাভ করিয়া আমাদের কল্পনাকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল। কিন্তু মাতা যে কোথায় প্রত্যক্ষ আছেন, তাহা কখনো স্পষ্ট করিয়া ভাবি নাই-লক্ষ্মী দূরে থাকুন, তাঁহার পেঁচক’টাকে পর্য্যন্ত কখনো চক্ষে দেখি নাই। আমরা বায়রনের কাব্য পড়িয়াছিলাম, গারিব্লডির জীবনী আলোচনা করিয়াছিলাম এবং প্যট্রিয়টিজমের ভাবরস-সম্ভোগের নেশায় একেবারে তলাইয়া গিয়াছিলাম।''

‘আইডিয়া’ যত বড়োই হউক, তাহাকে উপলব্ধি করিতে হইলে একটা নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধ জায়গায় প্রথম হস্তক্ষেপ করিতে হইবে। তাহা ক্ষুদ্র হউক, দীন হউক, তাহাকে লঙ্ঘন করিলে চলিবে না। দূরকে নিকট করিবার একমাত্র উপায় নিকট হইতে সেই দূরে যাওয়া। ভারতমাতা যে হিমালয়ের দুর্গম চূড়ার উপরে শিলাসনে বসিয়া কেবলই করুণসুরে বীণা বাজাইতেছেন, এ-কথা ধ্যান করা নেশা করা মাত্র-কিন্তু ভারতমাতা যে আমাদের পল্লীতেই পঙ্কশেষ পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়াজীর্ণ প্লীহারোগীকে কোলে লইয়া তাহার পথ্যের জন্য আপন শূন্যভান্ডারের দিকে হতাশদৃষ্টিতে চাহিয়া আছেন, ইহা দেখাই যথার্থ দেখা। যে ভারতমাতা ব্যাস-বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের তপোবনে শমীবৃক্ষমূলে আলবালে জলসেচন করিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাকে করজোড়ে প্রণাম করিলেই যথেষ্ট, কিন্তু আমাদের ঘরের পাশে যে জীর্ণচীরধারিনী ভারতমাতা ছেলেটাকে ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিখাইয়া কেরাণিগিরির বিড়ম্বনার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া দিবার জন্য অর্দ্ধাশনে পরের পাকশালে রাঁধিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাকে তো অমন কেবলমাত্র প্রণাম করিয়া সারা যায় না।“

কোটেশনগুলি দীর্ঘ মনে হতে পারে, কিন্তু প্রয়োজনীয়। যেমন ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে বাঙালি কর্মে পেয়েছে খ্যাতি, শিক্ষা-প্রসারণে হয়েছে অগ্রণী। সে দিন সেখানকার লোকের কাছে সে শ্রদ্ধা পেয়েছে, পেয়েছে অকুন্ঠিত কৃতজ্ঞতা। আজ রাজপুরুষ তার প্রতি অপ্রসন্ন, অন্যান্য প্রদেশে তার সম্বন্ধে আতিথ্য সংকুচিত, দ্বার অবরুদ্ধ। এদিকে বাংলার আর্থিক দুর্গতিও চরমে এল...

আজ হিন্দু-মুসলমানে যে একটা লজ্জাজনক আড়াআড়ি দেশকে আত্মঘাতে প্রবৃত্ত করছে, তার মূলেও আছে সর্ব্বদেশব্যাপী অবুদ্ধি। অলক্ষী সেই অশিক্ষিত অবুদ্ধির সাহায্যেই আমাদের ভাগ্যের ভিত্তি ভাঙবার কাজে চর লাগিয়েছে, আত্মীয়কে তুলছে শত্রু করে, বিধাতাকে করছে আমাদের বিপক্ষ।...

শেষকালে নিজের সর্ব্বনাশ করবার জেদ এতদূর পর্যন্ত আজ এগোল যে বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষার মধ্যেও ফাটল ধরাবার চেষ্টা আজ সম্ভবপর হয়েছে, শিক্ষার ও সাহিত্যের যে উদার ক্ষেত্রে সকল মতভেদ সত্ত্বেও এক-রাষ্ট্রীয় মানুষের মেলবার জায়গা, সেখানেও স্বহস্তে কাঁটাগাছ রোপণ করবার উৎসাহ ব্যথা পেল না, লজ্জা পেল না। দুঃখ পাই তাতে ধিক্কার নেই কিন্তু দেশজোড়া অশিক্ষাগ্রস্ত হেয়তা আমাদের মাথা হেঁট করে দিল, ব্যর্থ করে দিল আমাদের সকল মহৎ উদ্যম। রাষ্ট্রিক হাটে রাষ্ট্রাধিকার নিয়ে দরদস্তুর করে হট্টগোল যতই পাকানো যাক, সেখানে গোলটেবিলের চক্রাবাত্যায় প্রতিকারের চরম উপায় মিলবে না, তরীর তলায় যেখানে বাঁধন আলগা সেইখানে অবিলম্বে হাত লাগাতে হবে।’’

আবার দেশ নিয়ে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস' প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “ভারতবর্ষের প্রধান সার্থকতা কী, এ কথার স্পষ্ট উত্তর যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন, সে উত্তর আছে;  ভারতবর্ষের ইতিহাস সেই উত্তরকেই সমর্থন করিবে। ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি, প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যে অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয়রূপে অন্তরতররূপে উপলব্ধি করা, -বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয়, সেগুলিকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে আবিষ্কার করা।

এই এককে প্রত্যক্ষ করা এবং ঐকান্তিক বিস্তারের চেষ্টা করা ভারতবর্ষের পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক, তাহার এই স্বভাবই তাহাকে চিরদিন রাষ্ট্র-গৌরবের প্রতি উদাসীন করিয়াছে। কারণ, রাষ্ট্র-গৌরবের মূলে বিরোধের ভাব।”

এই হল রবীন্দ্রনাথের দুরদর্শীতা; দর্শন। সময় যে আবর্তিত হয় এবং আবর্তিত সময়কে যুগে যুগে একইরকম দেখতে লাগে, এই প্রবন্ধগুলি তারই প্রামাণ্য দস্তাবেজ। ঘরের জানালা দিয়ে সবটুকু দেখা না গেলেও মনের জানালা দিয়ে যতদূর প্রাণ চায় দেখা যায়। শৈশবে বাঁধা পরিবেশে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আলাপ করার প্রবল উৎকণ্ঠাই তাঁর স্নায়ুতে জন্ম দিয়েছিল কল্পনার... ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ ছোটবেলার এই ছন্দমিল বাক্যই ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতার আদি স্বাদ, যা শুধু শিশুপাঠ্য ছড়া হিসেবে মুখস্থ করার নয়, গভীর উপলব্ধির। তাঁর সময়ের অন্যতম মুক্তি-মুখ ছিলেন তিনি। তা-ই শুধুই ‘জনপ্রিয়’ রবীন্দ্রনাথ নয়, এ সময়ে উঠে আসুক প্রাসঙ্গিক অথচ উপেক্ষিত যে রবীন্দ্রনাথ।

 

 

তথ্যসূত্র: সংকলন


New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -মৌনী মন্ডল | 07-08-2020

// Event for pushed the video