করোনা যোদ্ধা আবার কীসের? ম্যালেরিয়া যোদ্ধা, টিবি যোদ্ধা, অনিয়মিত ঋতুস্রাব যোদ্ধা, আমাশা যোদ্ধা যখন নেই, তখন করোনা যোদ্ধা কোথা থেকে কেন এল?
করোনা নিয়ে ভারতে অজস্র মূর্খতার মধ্যে অগ্রগণ্য হল আক্রান্তদের যোদ্ধা আখ্যা দেওয়া। রোগের বিরুদ্ধে লড়াই বা যুদ্ধ হয়। রোগী কীসের যোদ্ধা? সমষ্টিগত ভাবে মানবসমাজের সঙ্গে এক অর্থে নিশ্চয়ই নভেল করোনা ভাইরাসের যুদ্ধ চলছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে রোগী কোনও যুদ্ধ লড়ছেন না। ব্যক্তি রোগীকে যোদ্ধায় পর্যবসিত করা মানে ভাবনা বা আইডিয়ার স্তরে একটা সর্বনাশের বীজ বপন করা। যে সর্বনাশের বীজ থেকে তৈরি বিষবৃক্ষে ইতিমধ্যেই ফল ধরতে শুরু করেছে।
কেন সর্বনাশ?
কারণ যুদ্ধে থাকে বিজেতা এবং বিজিত – Victor and Vanquished. যুদ্ধে জিতলে তা মানুষের চোখে খুবই বীরত্বের ব্যাপার। Covid-19 আক্রান্ত ব্যক্তি যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন, তখন এই আইডিয়া থেকেই তাঁকে ফুলমালা দিয়ে, দীপ জ্বালিয়ে, পুষ্পবৃষ্টি করে বরণ করা হচ্ছে। কিন্তু এই মুদ্রারই ঠিক উল্টো পিঠটা কী? যুদ্ধে জেতার উল্টোটা যা তাই - যুদ্ধে হেরে যাওয়া। যুদ্ধে হেরে যাওয়া চিরকালই অগৌরবের, লজ্জার। যে যুদ্ধে হেরে গেছে সে যথেষ্ট বলশালী ছিল না, যথেষ্ট সক্ষম নয়, যথেষ্ট নিপুণ নয়। তার মানে Covid-19 আক্রান্ত যারা মারা গেল, তারা যুদ্ধে পরাজিত। অর্থাৎ তারা আর সম্মানের, মর্যাদার যোগ্য নয়।
মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, যে অমর্যাদার সঙ্গে মৃত ব্যক্তিদের দেহের অন্তিম সংস্কার করা হচ্ছে – তা দাহ করেই হোক বা কবরস্থ করেই হোক – তার সঙ্গে এই ‘যুদ্ধে হেরো অতএব ফালতু’ মানসিকতার সম্পর্ক আছে। নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে অজস্র মানুষ আমাদের প্রত্যেকের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের একটা বড় অংশ জানেই না তারা সংক্রামিত, আমি নিজেই তাদের মধ্যে একজন হতে পারি। তাদের থেকে মৃতদেহ কোনওভাবেই বেশি মারাত্মক সংক্রমণের উৎস হতে পারে না। তবু মৃতদেহ পরিজনদের না দেখতে দেওয়া, শহর থেকে দূরে অন্যত্র দাহ করা ইত্যাদি চলে আসছে। 50 লক্ষ লোকের শহরে দশটি কেস থাকলে এভাবে সংক্রমণ হয়তো কমানো যেত। বাস্তবে 14 লক্ষ সংক্রামিত হলে (দিল্লির ক্ষেত্রে সেরো পরীক্ষায় যা ইঙ্গিত) গোটা কতক মৃতদেহ প্লাস্টিকে মুড়ে পোড়ালে জীবিতদের সংক্রমণের সম্ভাবনা বিন্দুমাত্র কমবে না।
যে করোনা যোদ্ধাদের নিয়ে মূর্খের মাতামাতি চলছে দেশজুড়ে, তারা কীসের বীরত্ব প্রদর্শন করল? রোগের জীবাণু মানুষকে আক্রমণ করলে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, তাতে কি আক্রান্ত মানুষের আলাদা করে গৌরব বা অগৌরবের কিছু আছে?
আমার শরীরটা অর্ধ শতাব্দীর বেশি প্রাচীন। এখন আমি যে কোনও দিনই Covid-19 রোগে আক্রান্ত হতে পারি (যদি না ইতিমধ্যেই হয়ে থাকি)। আক্রান্ত হলে দুটোই মাত্র সম্ভাবনা – হয় বেঁচে যাব, নয়তো মরে যাব। প্রতিটি মানুষের মতোই আমিও বাঁচতেই চাইব, কিন্তু প্রবলতম চাওয়া সত্ত্বেও মরে যেতেই পারি। যেমন কলকাতার বঙ্গ সমাজে পরিচিতদের ধরলে সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তী, ইতিহাসবিদ হরি বাসুদেবন, তৃণমূল বিধায়ক তমোনাশ ঘোষ প্রমুখ মারা গেছেন। আমার মনে হয় এঁদের সকলেই বাঁচতেই চেয়েছিলেন। Covid-19 আক্রান্ত আমি বাঁচব নাকি মরব তাতে আমার Free Will বা স্বাধীন ইচ্ছা এবং ক্ষমতার তো কোনও ভূমিকা নেই। ছোটবেলা থেকে যথেষ্ট প্রোটিন এবং ভিটামিন খাওয়ার বা না খাওয়ার ফলে আমার শরীরের ইমিউনিটি কতটা, তার একটা ভূমিকা থাকতে পারে। জিনগতভাবে আমি দক্ষিণ এশীয় (অতএব ডায়াবেটিস এবং বিশেষ কিছু ধরনের হার্টের অসুখের প্রবণতা বেশি), এস্কিমো বা জুলু ট্রাইবাল নই, তার একটা ভূমিকা থাকতে পারে। এ সবই তো জন্মসূত্রে পাওয়া। এগুলো থাকা না থাকা দিয়ে তো ‘করোনা যোদ্ধা’ হিসেবে আমার বিচার হতে পারে না।
অথচ প্রতি মুহূর্তে সমাজ সেই বিচারই করছে। আর সেই রাবণের চিতার মতো মূর্খতার আগুনে সমানে কাঠ গুঁজে যাচ্ছে ভারতের মিডিয়া এবং দেশের শাসক বর্গ। কারণ যুদ্ধের গল্পটা পাবলিককে খাওয়ানো গেলে যুদ্ধের একজন সেনানায়কের গল্পও খাওয়ানো সোজা।