ডাক্তারবাবু, আমার একটু শরীর খারাপ লাগছে।
কী হয়েছে?
কেমন যেন কোমর্বিডিটি কোমর্বিডিটি লাগছে!
এরপর ডাক্তার নিশ্চিন্তে রোগী দেখতে শুরু করলেন, হাসপাতালও সানন্দে রোগী ভর্তি করে নিল। কারণ, কোমর্বিডিটি খুব সুন্দর অসুখ! খুব সুবিধাজনক! এটা হলে সরকারের কোনও দায় নেই। এতে মানুষ মরলে কোমর্বিডিটির পরিসংখ্যানে নাম ওঠে, বিশেষজ্ঞ কমিটি বৈঠকে বসে, মিডিয়াতে চর্চা চলতেই থাকে। শুধু চিকিৎসা এবং মৃত্যু সংক্রান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি ডেথ-সার্টিফিকেটে কোমর্বিডিটি উল্লেখ না করলেও চলে।
যেমনটা হয়েছে হরি বাসুদেবনের ক্ষেত্রে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের এমেরিটাস অধ্যাপক হরি বাসুদেবনের মৃত্যুর এক মাস পর তাঁর স্ত্রী, কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেসের ডিরেক্টর আর এক প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতা জানতে চেয়েছেন তাঁর স্বামীর মৃত্যু ঠিক কীভাবে হয়েছিল। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত Covid-19-এ মৃতদের মধ্যে সম্ভবত হরির মৃত্যুই সবচয়ে বেশি আলোচিত এবং মিডিয়াতে চর্চিত। সল্ট লেকের সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতালের তরফে বলা হয়েছিল তাঁর অন্য দীর্ঘদিনের দুরারোগ্য ব্যাধি বা ক্রনিক অসুখ ছিল, করোনার পরিপ্রেক্ষিতে যার এখন পরিচিত নাম কোমর্বিডিটি। শোকবিহ্বল তপতী এক মাস মিডিয়াতে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর খবর নিয়ে কিছু দেখার মতো অবস্থায় ছিলেন না। 10 জুন দেখতে গিয়ে তিনি হাসপাতালের পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচারিত ভুল খবরের বিষয়টি খেয়াল করেন। ফেসবুক পোস্টে তপতী দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন যে হরির শ্বাসের অসুবিধার রোগ COPD, হাঁপানি, ফুসফুসের অন্য রোগ, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, কিডনির সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি কিছুই ছিল না।
তবু কেন হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোমর্বিডিটির কথা বলা হল?
কোমর্বিডিটিতে মৃত্যু হলে Covid-19-এর ঘাড়ে দায়টা কম পড়ে। করোনা সংক্রমণ রুখতে সরকার কাজ করছে। তা নিয়ে নিরন্তর চর্চা চলছে মিডিয়ায়। কাটাছেঁড়া বিচার বিশ্লেষণ চলছে। রাজ্যে রাজ্যে, দলে দলে, নেতায় নেতায় প্রতিযোগিতা চলছে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কে বেশি এগিয়ে। তাই করোনায় কম মৃত্যু মানে সুশাসনের প্রমাণ – এটাই সহজ যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত।
অন্যদিকে কোমর্বিডিটিতে সরকারের কোনও দায় নেই। কোন রহিম শেখের ডায়াবেটিস আছে আর কোন রামা কৈবর্ত বিড়ি ফুঁকে COPD বাধিয়ে বসে আছে তাতে সরকার কী করবে? বিতর্ক ওঠার পর হরি বাসুদবনের ক্ষেত্রে হাসপাতালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডেথ সার্টিফিকেটে তো কোমর্বিডিটির কথা বলা হয়নি! সত্যিই তো হয়নি। ঠিক সেটাই তো হরির চিকিৎসার বিষয়ে প্রশ্ন। মিডিয়াতে প্রচারের জন্য যে কথা বলা হল, তা ডেথ সার্টিফিকেটে নেই কেন? ডেথ সার্টিফিকেটে নেই সাফাই দিয়ে আইনের চোখে রেহাই হয়তো মিলতে পারে। কিন্তু স্বামীকে হারিয়ে এক মহিলা যে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলেছেন, যে নৈতিকতার কথা তুলেছেন, সেখানে তাঁর চোখে চোখ রেখে জবাব দিতে পারবেন তা কোমর্বিডিটিওয়ালারা?
তপতী গুহঠাকুরতার লেখার কিছু অংশ:
গত 10 মে, আমার স্বামী, ঐতিহাসিক হরি শঙ্কর বাসুদেবনের প্রয়াণের পর, তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে যে অসংখ্য শ্রদ্ধার্ঘ্য, শোকজ্ঞাপক বার্তা আমরা পেয়েছি এবং তাঁর প্রয়াণ সংক্রান্ত যে সংবাদগুলি প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো পড়ার মতো স্থৈর্য তখন আমার ছিল না।
আজ, 10 জুন, সেই দুঃখজনক দিনটার ঠিক একমাস পর আমি সেই সংবাদ প্রতিবেদনগুলির কিছু অংশ পড়ে দেখছিলাম। সেখানে হরির মৃত্যু নিয়ে যা সমস্ত কথা বলা হয়েছে, তা দেখে আমি শিহরিত হলাম। সেখানে বারংবার একই ধরনের মিথ্যা খবর (আমি এটাকে ইচ্ছাকৃত ভুল তথ্য পরিবেশনই বলব) প্রকাশ করা হয়েছে।
বিভিন্ন নামজাদা সংবাদমাধ্যম গুলিতে এই নিয়ে যে বিকৃত, অসত্য সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, আমি কোনওভাবেই সেগুলোকে মেনে নিতে পারছি না।
প্রত্যেকটি সংবাদ প্রতিবেদনে সল্টলেকের আমরি হাসপাতালের (যেখানে হরির চিকিৎসা হচ্ছিল) তথ্যসূত্রকে উল্লেখ করে কিছু ভ্রান্ত খবর করা হয়েছে। বলা হয়েছে তাঁর অন্যান্য জটিল রোগও ছিল।
হরি (যার গত ফেব্রুয়ারি মাসে 68 পূর্ণ হয়েছিল) কোনও দুরারোধ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ছিলেন না। হরির অন্যান্য রোগের কোনও উপসর্গ ছিল না, চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ‘কো-মর্বিডিটিস' বলা যেতে পারে। COPD-র মতো ফুসফুসের কোনও রোগ, হাঁপানি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপজনিত অসুখ, কিডনি বা হৃদযন্ত্রের সমস্যাও তাঁর ছিল না।
সেই কারণেই আমরা, হরির পরিবার ও বন্ধুবান্ধবরা অবাক হয়েছিলাম যে, কী করে এমন প্রাণবন্ত, কাজ পাগল, কর্মোদ্যম মানুষটি কোনওরকম রোগে না ভুগে, মাত্র এক সপ্তাহের জ্বরে করোনার কাছে হেরে গেলেন।
কিন্তু তাঁর মৃত্যু নিয়ে আমরি হাসপাতালের পক্ষ থেকে যে মিথ্যা সংবাদ দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এবং নিন্দাজনক। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং প্রশাসনের তরফে যেভাবে হরির মৃত্যুর কারণকে কোমর্বিডিটিস হিসাবে দেখানো হল, তা প্রতারণার তুল্য। আমি এদের কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না।
সেই মানুষটি আর আমাদের মধ্যে নেই। টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিচারের আর মানে হয় না। কিন্তু, এই কথাগুলো বলা এই কারণে জরুরি যে, যখন করোনা সংক্রমণ প্রতিদিন আমাদেরকে নিঃশেষিত করছে, তখন এই রোগে আক্রান্ত, পর্যুদস্ত মানুষগুলো— সে সাধারণ কোনও মানুষ হোন বা সমাজের উচ্চস্তরের কেউ— তাদের সম্পর্কে কোনও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ, এই সময়ে এ ব্যাপারে স্বচ্ছতা বজায় রাখা খুব জরুরি ছিল।
নার্সিংহোমে ভর্তি করার পর, ওই বিভীষিকাময় পাঁচটা দিনে হরির ঠিক কী হয়েছিল, সেই সম্পর্কে আমরি হাসপাতালের তরফ থেকে আমি এখনও পর্যন্ত কোনও বিস্তারিত তথ্য বা রিপোর্ট পাইনি। গত 4 মে রাতে, যখন আমাদের গাড়ি করে আমি হরি-কে সেখানে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছিলাম, তখনও মানুষটা হাঁটছে, কথা বলছে, যথেষ্ট সচেতন। সেই মানুষটাকে আমি আর কখনও দেখতে পাব না।
আমি এই পরিস্থিতিতে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট বা তদন্ত চাইব না। কিন্তু দেশে, দেশের বাইরে হরির যে অগণিত ছাত্র, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীরা আছেন, যাদের নিরন্তর শ্রদ্ধা, ভালবাসা হরি এতদিন পেয়ে এসেছেন, তাদের অন্তত সত্যটা জানার অধিকার আছে। সকলের জানা উচিত ঠিক কোন পরিস্থিতিতে কেন এবং কীভাবে হরি অকালে আমাদের ছেড়ে গেলেন। এটুকু হরির প্রাপ্য।
(ভাষান্তর: বিতান ঘোষ)