ডলফিনের মতো নাকের ডগাটা, আকারে বিশালাকায় তিমি, আবার ডানা মেলে আকাশেও ওড়ে! এবার ওর পেটে ছিল দু’ দু’টো আস্ত হেলিকপ্টার। আর 23 বছর আগে যখন এখানে নেমেছিল সেবার ছিল ‘স্বাধীনতা’! স্বাধীনতার যে আইকন সারা বিশ্ব প্রায় দুশো বছর ধরে চেনে, সেই Liberty Leading The People-কে সে প্যারিস থেকে টোকিও নিয়ে যাচ্ছিল। শিল্পকর্মকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিতে প্রযুক্তির ব্যবহার কোথায় যেতে পারে তার অপূর্ব নিদর্শন ছিল বেলুগা এয়ারবাসের সেই ফ্লাইট।
উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি চিত্রকর ইউজিন দেলাক্রোয়ার আঁকা Liberty Leading The People-কে চেনার জন্য শিল্পপ্রেমী হওয়ার দরকার হয় না। মাথায় স্বাধীনতার প্রতীক বিশেষ ধরনের টুপি (ফ্রিজিয়ান ক্যাপ) পরা এক নারী পতাকা হাতে সশস্ত্র এক জনতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁর স্তন উন্মুক্ত, মুখে দৃঢ় প্রত্যয়। 1830 সালের ফরাসি বিপ্লবের (জুলাই বিপ্লব) এই ছবিটি স্বাধীনতার জন্য সাধারণ মানুষের সংগ্রামের এক অনন্য নান্দনিক দলিল। মূল ছবিটি দৈর্ঘ্যে প্রায় 12 ফুট, উচ্চতায় 10 ফুট। দুনিয়ার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মিউজিয়াম প্যারিসের ল্যুভর হল এর স্থায়ী ঠিকানা। 1999 সালে জাপানের টোকিওতে একটি প্রদর্শনীর জন্য ছবিটি প্যারিস থেকে টোকিও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নিয়ে গেছিল এই বেলুগা এয়ারবাস। কলকাতায় সেবারও বিশ্রামের জন্য নেমেছিল ‘স্বাধীনতা’ সহ বেলুগা।
আরও পড়ুন: ‘বং বং’-রা গড় বাঁচালেও ‘পাপ্পু’ সেই তিমিরেই!
অমর চিত্রশিল্পেরও কালের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা লয় ক্ষয় ঘটে। বাতাসের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা এবং চাপের পরিবর্তনে এই ক্ষয় দ্রুততর হয়। তা ছাড়াও ছবিতে আঘাত লাগলে বা অতিরিক্ত কম্পনেও তার ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। 1999 সালে Liberty Leading The People-কে সুরক্ষিতভাবে 9700 কিলোমিটার পথ উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেলুগা এয়ারবাসকেও বিশেষভাবে তৈরি হতে হয়েছিল। ছবিটিকে একটি বিশেষভাবে প্রস্তুত বিশালাকায় কন্টেনারে করে তিমি সদৃশ দানবাকৃতি প্লেনের পেটে ঢোকানো হয়েছিল। জাইরোস্কোপ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল ওই কন্টেনার নির্মাণে, যাতে প্লেনটি মাটির সঙ্গে যে অনুভূমিক অবস্থানে (সমান্তরাল বা সামনের দিকটা উঁচু) থাকুক না কেন, ছবিটি সব সময়েই সমান্তরাল থাকবে। প্লেনের ভিতরে বাতাসের চাপ, তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার পরিবর্তন ঘটে, যার জন্য সাধারণ যাত্রিবাহী প্লেনে যাত্রীদের কানে তালা লাগা এবং এয়ার ভেন্ট থেকে কুয়াশার মতো হাওয়া বের হতে দেখা যায়। Liberty Leading The People নিয়ে যাওয়ার জন্য ওই কন্টেনারের ভিতরে প্লেনের স্বাভাবিক কম্পন পৌঁছাবে না এবং প্লেনের ভিতরে বাতাসের চাপ তাপমাত্রা বা আর্দ্রতার পরিবর্তন হলে তা ছবিতে পৌঁছাবে না এংন ব্যবস্থাও ছিল। এত সব করতে গিয়ে কন্টেনারটির আকার হয়ে দাঁড়ায় মূল ছবির থেকে বেশ কয়েকগুণ বড়। আর তার জন্যই বেলুগা এয়ারবাস।
1830 সালে বিপ্লবের কল্পিত নেত্রীর ছবিতে রক্ত, ক্লেদ, ঘাম, বারুদের গন্ধ ছবিটির সামনে দাঁড়ালে প্রায় প্রত্যক্ষ করা যায়। 170 বছর পর লেডি লিবার্টি অবশ্য ভিন্ন মহাদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন অতীব সুরক্ষিত হয়ে, প্রায় সোনার পালঙ্কে তুলোর গদিতে শুয়ে!