কেবারে অন্য নারীদের মতোই সলজ্জ ও সম্ভ্রমশীলা। কথাটা শুনে অবাক লাগতে পারে, কারণ দারুণ বিদ্রোহিনী হিসেবেই ইসমত সাধারণ্যে পরিচিত, কিন্তু প্রথম যেদিন তাঁর সঙ্গে মান্টোর সাক্ষাৎ হয়েছিল মুম্বাইয়ের এক বহুতলে, সেদিন তাঁর ইসমত সম্পর্কে এমন কথাই মনে হয়েছিল। স্ত্রী সাফিয়াকে লিখেছিলেন, "আশ্চর্যজনকভাবে, ইসমতও তোমার মতোই এক নারীই!'
সে এমন এক সময়, যখন ইসমতের "লিহাফ' বা লেপ নামের গল্পটি সদ্য প্রকাশিত হয়েছে। সে কাহিনির উপজীব্য হল এক ধনী ও সম্ভ্রান্ত নারীর (গল্পে পরিচয় বেগমজান) এক পরিচারিকার (নাম রব্বু) সঙ্গে তীব্র দৈহিক সম্পর্ক। ইসমত অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বেগমের শূন্য দাম্পত্যের ছবি এঁকেছিলেন।
লিখেছিলেন, "বেগমজান দিওয়ানখানার দরজায় ছেলেদের আন্দোলিত কোমর, সুন্দর ঊরু আর শিশিরের মতো স্বচ্ছ কুর্তার কম্পন দেখতেন। তাঁর দু'চোখ রাগে জ্বলে উঠত। যখন এই ছেলেদের কাছে তাঁর পরাজয় হল... তিনি লেখাপড়ার দিকে মন দিলেন। কিন্তু তাতে তাঁর একাকীত্ব বাড়ল বই কমল না। প্রেম ও বিরহের কবিতা পড়ে পড়ে তিনি ক্রমশ নিরাশার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলেন। রাতের ঘুম উধাও হল। বেগম হতাশা ও বাসনার প্রতিমূর্তি হয়ে দিন কাটাতে লাগলেন।'
কিন্তু মুশকিল হল, সেকালের পাঠক সমাজের একাংশ এমন স্পষ্টবাদিতা মেনে নিতে পারল না। হোক না গল্প, তবু গল্প তো সমাজেরই সত্যরূপ। এমন বলিষ্ঠ সত্য ক'জনই বা স্বীকার করতে পারে! তাই অশ্লীলতার দায়ে মামলা চলল লাহোর আদালতে। সময়টা 1942, ইংরেজের ভারত পরিত্যাগের দাবিতে নানা পরস্পরবিরোধী স্রোত নিয়েই সে সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও উত্তাল।
এরকম সময়েই মান্টোর সঙ্গে প্রথম দেখা হল ইসমতের। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী শাহিদ লতিফও। সাহিত্য নিয়ে আলাপচারিতায়, মান্টো ও ইসমতের তর্কবিতর্কে এত রাত হয়ে গেল যে, ওঁরা তিনজন মিলে স্থির করলেন মান্টোর ওখানেই রাতের খাওয়া সারা হবে। হোটেল থেকে আনানো খাবার খেতে খেতে ইসমতের গল্প নিয়ে কথাবার্তার সময় মান্টো লক্ষ্য করলেন, তিনি যতবারই লিহাফ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, গল্পটির বলিষ্ঠতার প্রশংসা করেন, ততবারই ইসমত সংকুচিত বোধ করেন, আড়ষ্ট হয়ে যান। মান্টো বুঝেছিলেন ইসমত যৌনতার প্রসঙ্গে খোলাখুলি আলোচনায় মোটেই স্বচ্ছন্দ নন তাঁর নির্ভীক স্পষ্টবাদী কলমটির মতো।
আর সেখানেই বোধহয় ইসমতের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ। প্রেমকে একেবারে নস্যাৎ করে একমাত্র জৈব প্রয়োজনকেই ধ্রুব রূপে প্রতিষ্ঠা করবার বদলে নারীর সলজ্জ কিন্তু সসম্মান প্রেমকেও গল্পে সমান জায়গা দিয়েছেন তিনি। প্রেমকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার কাজ নারীর নয়, এবং তাতে তার বিদ্রোহিনী সত্তারও যে কোনও হানি হয় না, এমন সঙ্গত বিশ্বাস এবং গল্পের মধ্যে তা প্রকাশ করবার দ্বিধাহীন বাসনাও তাঁর ছিল। এমন বহুমাত্রিকতা খুব সুলভ নয় এদেশের সাহিত্যে।
উদাহরণ সকলের চোখের সামনেই রয়েছে। এম এস সথ্যুর "গরম হাওয়া' ছবিটির কথা মনে করুন। ইসমতেরই একটি ছোট গল্পের ভিত্তিভূমিতে তৈরি এই ছবিটি। ধর্মের নিরিখে দেশভাগ হওয়া সত্ত্বেও একটি মুসলমান পরিবারের প্রাণপণে এ দেশের মাটিকে আঁকড়ে থাকার আবেগকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত এই অবিস্মরণীয় ছবিটির কাহিনি। ছবির অন্যতম তরুণ চরিত্র আমিনা (গীতা সিদ্ধার্থ অভিনীত) এক কোমল রোম্যান্টিক প্রেম এবং তার পরিণতিতে সুখী বিয়ের স্বপ্ন দেখা কন্যে। কিন্তু বারবার, কখনও দু'দেশের পারস্পরিক কূটনৈতিক কারণে, কখনও বা যৌনতার প্রশ্নে অধিকাংশ পুরুষের স্বভাবসিদ্ধ দুর্বল, বহুগামী চরিত্রের ফলে সে স্বপ্ন ব্যর্থ হয়। বিয়ের জোড় গায়ে জড়িয়ে নিয়ে তার অন্তিম পরিণতি অনেকের কাছেই আজ পর্যন্ত দেখা অন্যতম করুণ বিয়োগান্তক দৃশ্য। ইসমত এখানে প্রেমকে এতটাই মূল্য দিয়েছেন যে, তার অভাবে জীবনকে পরিত্যাগ করা তাঁর কাছে অসম্ভব মনে হয়নি।
অনেকেই সঙ্গত কারণে বলতে পারেন যে অন্যের তৈরি ছায়াছবির বক্তব্য ইসমতের উপর পুরোপুরি বর্তাতে পারে না। তা মেনে নিতে অবশ্য কোনও অসুবিধে নেই কারণ আরও বেশ কিছু অকাট্য প্রমাণ আমাদের হাতে আছে।
যেমন ধরা যাক "কাফের' নামের গল্পটি। প্রায় সমবয়সী দুই ভিনধর্মী তরুণ তরুণীর বাল্যপ্রেমের গল্প। সেখানে হিন্দু বালক পুষ্কর অবলীলায় মুসলমানী মুন্নির এঁটো কুল খায়, দু'জনে সুযোগ পেলেই হিন্দু মুসলমানের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তুমুল ঝগড়া করে। পরে বড় হয়ে দূরে বেনারস কলেজে পড়বার সময় বড়দিনের ছুটিতে এসে পুষ্কর অনেকদিন ধরে বাঁচিয়ে রাখা নিষিদ্ধ আবিরও অবলীলাক্রমে মুন্নির মুখে মাখিয়ে দেয়। আলিগড় কলেজের ছাত্রী মুন্নির পড়ার টেবিলে রাখা পুষ্করের দেওয়া শ্বেত পাথরে খোদাই করা কৃষ্ণের মূর্তি, তার পায়ের কাছে ছোট একটি ফ্রেমে পুষ্করের ছবি, আর সে ছবিকে ঘিরে মুন্নির নানা রকম কল্পনা, এককথায় রোম্যান্টিক প্রেম আর ধর্মনিরপেক্ষতার একেবারে দারুণ একটা সংশ্লেষ, পাঠক এই প্রেমের পরিণতি জানবার জন্য এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেন গল্পটা। প্রেমের তো এমনই মহিমা, এবং মানতেই হবে এ ছাড়া এমন সার্থকভাবে এই মিলনের কথাটা বলাও যেত না, এবং সম্ভবত ইসমত ছাড়া এর আগে এমন করে আর কেউ বলতে পারেনও নি।
আর একটা গল্পের কথা বলি। নাম "পহলী লড়কী' বা প্রথমা নারী। এখানেও দু'টি নবযৌবন প্রাণ। হারমা এক অতীব সম্পন্ন পরিবারের কন্যা, মনসুর তার দাদা রশিদের বন্ধু, সাধারণ পরিবারের একটি ছেলে, এই দু'জনের মধ্যে প্রণয়। রশিদ আর মনসুর দু'জনেই আবার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী। সেদিন হারমাদের বাড়িতে এক পানভোজনের আসরে মনসুরও যোগ দিয়েছিল, তারপর কী এক কারণে হারমার দু'চোখে জল দেখে মনসুর উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, "কী হয়েছে?'
"এরপর বাগানের ঝাঁকড়া মহুয়া গাছটার নিচে দু'জনে -
"উফ, এই মেয়েদের কামিজ খোলে কীভাবে? হাজার বোতাম। লাখ খানেক হুক!' ড্রয়িং রুমে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা মিউজিক্যাল চেয়ার খেলছিল। তাদের হাসি আর হাততালির আওয়াজ দূর কোনও পৃথিবী থেকে ভেসে আসছিল। চারদিক শুনশান, শুধু দুজনের হৃৎস্পন্দন শোনা যাচ্ছিল।
মনসুর মন্ত্রমুগ্ধের মতো হারমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট আর কামনায় উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর কাগজের মতো সাদা গালে তখনও মুক্তো ঝিকমিক করছিল। জ্যোৎস্নার পারা কুমারী বুক পদ্মের মতো কাঁপছিল। ঠান্ডা মাটিতে উত্তপ্ত হারমা আর চার বড় পেগের নেশা।
চোখ। নিষ্পাপ সরল চোখ। অজানা ইচ্ছেয় ঝলসে ওঠা চোখ। হারমার চোখ, মনসুরের চোখ। প্রেয়সীর চোখ, প্রিয় বন্ধুর চোখ।
হঠাৎ যেন কেউ মনসুরকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিল। ও স্তব্ধ হয়ে গেল। কনুইয়ে মুখ লুকোল। হারমার ভীত হাত ওকে স্পর্শ করল। তার দু'চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রুধারা বয়ে চলেছিল। কান্না গুমরে উঠছিল।
অনেকক্ষণ দু'জনে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইল। যখন নিঃশ্বাসের তীব্রতা কমে এল, সবকিছু শান্ত হয়ে গেল- তখন মনসুর হারমার ঠান্ডা হাতদুটো নিজের জ্বলে যাওয়া চোখের উপর রাখল। তার মধ্যে কামনা ছিল না, লোভ ছিল না, ছিল নরম লাজুক প্রেম।'
ইসমতের প্রিয় বন্ধু মান্টোর সঙ্গে এখানেই তাঁর তফাত। কারণ, ওই যে মান্টোর কথামতই, তিনি শেষ পর্যন্ত একজন নারীই!
কিছুদিন আগের জন্মদিনে ইসমতের বয়স হল একশো পাঁচ। কিন্তু আজও কী তারুণ্য তাঁর লেখায়!
জিও ইসমত আপা।
সহায়ক গ্রন্থ : ইসমত চুগতাই কে সও আফসানে