‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন…’- না, দু দণ্ড শান্তি নাটোরের বনলতা সেন দেননি, তিনি স্বপ্নের নারী, আর যদি তিনি তা নাও হতেন তবুও সেক্ষেত্রে এক ক্লান্তপ্রাণ নারীর কী হবে সে প্রশ্ন থেকেই যেত, শান্তি আসলে দিতে পারে কোনও শিল্প, প্রাণ ভরিয়ে দিতে পারেন আসলে শিল্পীরাই, তাঁদের অকৃত্রিম, তীব্র, অকৃপণ দানে।
আর এক্ষেত্রে একেবারে প্রথম সারিতেই রয়েছেন মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের শিল্পীরা। একথায় যদি ভ্রূ কুঞ্চন করেন তাহলে বলব মহামারী আপনাকে কিছুই শেখাতে পারেনি। এখন তো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে ওই কুলি, মুটে, মজুরদের প্রাণ আপনার, আমার প্রাণের মতই মূল্যবান। ওদের মধ্যে মহামারী ছড়িয়ে পড়লে আপনি আমিও...। কাজেই ‘সস্তা’ বলে তাদের বিনোদনকে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না, বিশেষ করে যখন অনেক প্রতিভাবান কবি, শিল্পী, ফোটোগ্রাফার এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
আকবর অমর অ্যান্থনি, ফিল্মটির নাম একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লেখা হয়েছে, সৎভাবে বলুন তো, এসব ছবি যখন তৈরী হয়েছে সত্তরের দশকে, তখন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের নামমাত্রও টের পেয়েছেন ভারতবর্ষে? ওসব উৎপাত তো শুরু হল 90-এ, কুখ্যাত রথযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে এবং 92-এ বাবরি ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পরের বছর বম্বে ব্লাস্ট এর সময়। না না, এই ভ্রাতৃত্ব বোধের সঙ্গে মুক্তির দশক, বাংলাদেশ যুদ্ধ কিম্বা জরুরি অবস্থার কোনও সম্পর্ক নেই, আসলে তখন আপামর ভারতবাসীর মন ছিল অন্য তারে বাঁধা এবং যার মূল কৃতিত্ব ছিল হিন্দি ফিল্মজগতের। অনপড় মানুষের মনে ভাইচারার মেসেজ সে দিয়ে গেছে ক্রমাগত। হার্টথ্রব নায়ক নায়িকারা কখনও স্বনামে কখনও বা বেনামে অনাবিল প্রেমের স্রোতে ভাসিয়েছেন জনতাকে।
প্রেমের কথায় আপত্তি করবার কিছু নেই কারণ নিরক্ষর অথচ জ্ঞানী কবীর বহু আগেই সতর্ক করেছেন - ‘পঢ়ি পঢ়িকে পথথর ভয়ে’- পণ্ডিতেরা পড়ে পড়ে সব হলেন পাথর, প্রেমের ছিটেফোঁটাও পারে না তাঁদের মনে প্রবেশ করতে - আর সেই প্রেমের বন্যায় ভেসেই ভারতের সাব অলটার্নরা, যাদেরই মূলতঃ দাঙ্গা হাঙ্গামার কাজে লাগানো হয়, পারস্পরিক বিভেদ ভুলে থেকেছে। আর একথাও ভুললে চলবে না যে মহম্মদ রফির ‘অভি না যাও ছোড়কর’ বা কিশোরের ‘পল পল দিল কে পাস’ একালের প্রজন্মও নতুন করে শুনছে।
নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার আবেগ যেমন উত্তম সুচিত্রার পরস্পরের দিকে ছুটে আসার দৃশ্যে বিধৃত, তেমনই হিন্দি ছবিতেও অনেক অহৈতুকী প্রেম জাতপাত, ধর্ম সবকিছুর বাধা তুচ্ছ করে দিয়েছে। ‘কর্জ’ ছবির একটি দৃশ্যে অনাথ, নিরাশ্রয় ঋষি কাপুরের ধনী শেঠের বাধা অগ্রাহ্য করে ‘দর্দ এ দিল’ গেয়ে ওঠা একইসঙ্গে ক্ষমতাবানের বিরোধিতা এবং প্রেমের জয়কে সূচিত করে। এ ছবিটি আমি রিলিজের অব্যবহিত পরেই দেখেছিলাম মহারাষ্ট্রের লোনাভলা শহরের একটি হলে। ঘটনাচক্রে ছবির নায়িকা টিনা মুনিমের মত আমিও তখন ষোল, এ দৃশ্য দেখার পর আমার যা হবার তা তো হলই কিন্তু দেখলাম সম্পূর্ণ ভিন্নভাষী দর্শকরাও ঠিক একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। আবেগের যে কোনও আলাদা ভাষা হয় না!
ঋষি আসলে এক পরম্পরার ফসল। আই পি টি-এর অন্যতম সংগঠক রাজ কাপুর, যিনি তাঁর ছবিতে সোশ্যালিজম এবং সেক্সকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন, তিনিই প্রথম টিন এজ লাভ নিয়ে এলেন টিনসেল টাউনে, ‘ববি’ ছবির মাধ্যমে এবং সেই থেকেই ঋষির ইনোসেন্ট এবং ইনটেন্স প্রেমিকের ইমেজ বাঁধা হয়ে গেল। বয়ঃসন্ধি অনেকসময় অপরাধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় পুরুষদের। সে সময় মধুর কোমল প্রেম যদি তাকে সুস্থ ও স্বস্থ রাখে, তবে তো সেটিই শিরোধার্য। ‘খেল খেল মে’, "কভি কভি’, ‘দুসরা আদমি’, "বদলতে রিশতে’ ইত্যাদি ছবির আধুনিক সব চরিত্রের সঙ্গে ‘সরগম’-এর গ্রাম্য সৎ, নিষ্ঠাবান তরুণ, কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ‘লায়লা মজনু’ ছবির মৃত্যুঞ্জয়ী দয়িত, ‘জজবা এ ইশক ও ওয়াফা’, প্রেমের তীব্র আবেগের প্রতীক হয়ে রয়েছেন ঋষি। তাই পরবর্তীকালের নানা চরিত্রের অভিনয় আর তেমন উল্লেখযোগ্য নয় অন্তত আমাদের প্রজন্মের কাছে।
এবং ঠিক সেজন্যেই ‘অমর আকবর অ্যান্থনি’ ছবিতে ‘পর্দা হ্যায় পর্দা’ গানে, দরবারীতে বাঁধা কাওয়ালিতে যখন মহম্মদ রফির অনুপম কন্ঠ পঞ্চম, মধ্যম, কোমল গান্ধার, ষড়জ, রেখাবকে স্পর্শ করে শেষপর্যন্ত তারার কোমল গান্ধারকে আলিঙ্গন করে এবং আকবরের দয়িতা তার কাছে আত্মনিবেদন করে, তখন সেটি একটি অন্যতম সেরা প্রেমের দৃশ্য বলে গণ্য হয়। একইভাবে যখন অমর, আকবর ও অ্যান্থনি তাদের আহত মায়ের জন্য রক্ত দেয়, তখন সেটি এই দুর্ভাগা জন্মভূমির প্রতি এক সম্মিলিত জীবনদানের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। প্রেম তা সে যে রূপেই হোক, কেবলমাত্র বাঁচাতে পারে এই দেশকে।
ঋষি তাঁর অন্তিম ট্যুইটে এমন কথাই লিখেছিলেন।