4thPillar


বাইশে শ্রাবণে তিনি তো রয়েই গেলেন সুস্মিতা ঘোষ | 08-08-2022

সুস্মিতা ঘোষ | 08-08-2022April 18, 2023
বাইশে শ্রাবণে তিনি তো রয়েই গেলেন সুস্মিতা ঘোষ | 08-08-2022

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় আমার সেই ছোট্টবেলায়, সামনের বাড়ির প্রতিবেশী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরাজ গলার রেসোনান্স যখন আমাদের বাড়িটাকেও কাঁপিয়ে দিত, তখন থেকে। আর বাবা অধ্যাপক, বাড়িতে রবীন্দ্র রচনাবলীর পুরো সেট, সে যুগের আর পাঁচটা বাংলা মিডিয়ামে পড়া বইপোকার যা হয়, বুঝে না বুঝে যখন তখন সেই বইগুলো পড়া। এই করেই রবীন্দ্রনাথ আমার মধ্যে ঢুকে গেছেন, যেমন আমার এবং আমার আগের প্রজন্মের আরো অনেকের।

বড় হলাম, বুড়ো হলাম, তিনি মধ্যে রয়েই গেলেন। আজো শ্রান্ত দিনের শেষে শান্তি আনে একখানা বাংলা বই- পুরোনো আমলের- তালিকার ওপরে সেই তিনিই। কাগজের বই এর জায়গা নিয়েছে ট্যাব বা ফোন, আর গল্পগুচ্ছের দুঃখের গল্পগুলো বাদ দিয়ে এখন পছন্দ তাঁর প্রবন্ধ। গবেষণা যেহেতু আমার পেশা, এখন তাঁর রচনা আমি কিছুটা গবেষকের চোখ দিয়ে দেখতে শুরু করেছি। আর বয়স তো আরো অনেক অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে  আজ বাইশে শ্রাবণ বলে নয়, এই ক্রান্তিকালে বারবার মনে হয় তাঁর মতো মানুষের আজ বড় প্রয়োজন ছিল। তাঁর মতো গভীর মানবিক অন্তর্দৃষ্টি কারই বা ছিল। কিন্তু সেযুগেও তো তাঁর কথা কেউ শোনে নি, এ যুগে কি শুনবে!

গত সপ্তাহে খবরে চোখ গেল, হেডলাইনে- বাংলাদেশের কে এক ইন্টারনেট সেনসেশন বলেছে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ভগবান নন- তাই নিয়ে তার ওপর গান গাওয়ার ব্যান ইত্যাদি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ- নজরুল ভগবান নন, এ কথাটা সমর্থন করতেন তাঁরা নিজেরাই। আর রবীন্দ্রনাথ-নজরুল এক সঙ্গে উচ্চারণ করার প্রতিবাদ করতেন নজরুল নিজেই। যতদিন যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা, সৃজন ক্ষমতা, কর্ম ক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব সব কিছু মিলিয়ে তাঁকে সারা পৃথিবীর সব মানুষের চেয়ে উর্দ্ধে মনে হয় আমার। মনে পড়ে গেল তিন শতক আগে, যখন পড়াশুনো করতে আমেরিকায় পা রেখেছিলাম, তার ঠিক পরে পরেই সে বছরের নোবেল পুরষ্কার ঘোষণা হল একজন প্রাপককে দেখলাম খুব কাছ থেকে। মনে হল ইনি আমার চেয়ে কিছুটা বেশি বুদ্ধিমত্তাবান। তার পরেই মনে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ও তো নোবেল লরিয়েট- তাঁর সঙ্গে এঁদের কারুর তুলনা চলে কি? তারপর থেকেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথ কে ওই  নোবেল পুরষ্কার প্রাপকের গণ্ডীতে বেঁধে রাখা একেবারেই অনুচিত। 

তবে নোবেল পুরষ্কার তাঁর নাম যশের ক্ষেত্রে অনেকটাই হয়তো সাহায্য করেছিল। তার পরেই  ভারতের এবং  বহির্বিশ্বের সমস্ত প্রধান ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয় । আজকের দিনে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে, কিন্তু এইসব অনুবাদ পড়েই লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন ভাষাভাষী তাঁর লেখার ভক্ত হয়ে পড়ে। গত শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেন। বিমানে মাত্র দুয়েক বারই চড়েছেন। কাজেই মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি এবং জাহাজ- থামতে থামতে যাওয়া। যেখানেই থেমেছেন, সেখানেই শুধু শত শত নয়, হাজার হাজার ভক্ত এসেছে মালা-উপহার নিয়ে, কেউ অটোগ্রাফ প্রত্যাশী- কেউ বা শুধুই দর্শনের। এতে কবি অনেক সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়তেন, কাজে কর্মে ব্যাঘাত ঘটত, কিন্তু রূঢ়তা দূরে থাক, কাউকে প্রত্যাখ্যান ও করেননি। জার্মানিতে তাঁর জীবৎকালে তাঁর বই ছিল বেস্ট সেলারের দলে, ইতালিয়ান ও জার্মান ভাষায় ডাকঘর এর শো হাউসফুল যেত। জার্মানিতে তাঁর বক্তৃতা শুনতে এত লোক হয়েছিল যে হলের বাইরে থাকা দর্শকরা দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে আমার সতীর্থ একটি ইতালিয়ান মেয়ের ভাই আমায় বলেছিল সে "তাগোর"-এর "চিত্রা" উপস্থাপনা করেছে। আর্জেন্টিনার ভিত্তোরিয়া ওকাম্পুর রবীন্দ্রপ্রীতি নিয়ে তো অনেক মুখোরোচক কাহিনীই আছে। চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, প্রাচ্যের দেশগুলিতে ও প্রায় একই চিত্র।


বাইশে শ্রাবণে তিনি তো রয়েই গেলেন সুস্মিতা ঘোষ | 08-08-2022

একটা প্রশ্ন কিন্তু আমার মনে থেকেই যায়- গীতাঞ্জলির গানগুলি পড়তে আমার প্রাণের আরাম, শুনতে আমার আত্মার শান্তি। সেই গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ- যা তাঁকে নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিল- কোনও দিন সেই আগ্রহে পড়তে পারিনি। তাঁর Crescent Moon এর ইংরেজি অনুবাদ কবিতা গুলি স্কুলপাঠ্য বইতে থাকে। আমার কন্যা যখন চতুর্থ শ্রেণীতে, তখন ওদের পড়তে হয়েছিল The Champa Flower. "I know the original" বলে সে যখন  "লুকোচুরি" কবিতাটি  ক্লাসে শোনায়- এক ক্লাস মরাঠি ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষিকা মন্ত্রমুগ্ধের মতো রবীন্দ্রনাথের বাংলা শব্দ ও ছন্দের স্পর্শ নেয়। ইংরেজি কবিতাটির ছায়াটি মনের ওপর সেই দোলাটি দেয় নি। কিছু কি lost in translation? British কবিরা তাঁকে mystic poet আখ্যা দিয়েছিল- সে কি তাঁর না-বোঝা বাণীর কারণে? না কি ইংরেজির চেয়ে অন্য ভাষায় অনুবাদগুলো বেশি সরেস হয়েছিল, রসভঙ্গ ঘটেনি? ধন্দে পড়ে যাই- এত এত মানুষের উন্মাদনা তাঁকে নিয়ে, সে কি বুঝে, না, না বুঝে?

কলেজে পড়তে পড়লাম ঘরে বাইরে আর চার অধ্যায়। চার পাশের ছাত্র রাজনীতি করা অনেক নেতা- নেত্রীর মধ্যে ঘরে বাইরের সন্দীপ আর চার অধ্যায়ের অতীনকে দেখতে পেতাম। নকশাল আমলের সময়ে আমি অনেক ছোট, তাই ঘরে বাইরের অমূল্যদের সরাসরি দেখতে পাই নি। অমূল্যরা সত্তরের দশক অবধি ছিল, তারপরে বাংলার যৌবন চালাক হয়ে গেছে। আমার প্রশ্ন, এতদিন লাগল কেন? রবীন্দ্রনাথ তো অনেক দিন আগেই এসব চরিত্র এঁকে গেছেন। লোকে কি তবে পড়ে বুঝত না

সত্যি কথা বলতে কি গত পাঁচ সাত বছরের আগে রাজনীতি নিয়ে অতটা মাথা ঘামাতাম না। মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হত না। আমার ধারণা ছিল রাজনীতিক মাত্রেই চোর, তাদের সরাসরি ল্যাজে পা দেবার সুযোগ আমার কম, কাজেই নিজে সৎ থাকলেই হল- ছোটখাট আঘাত হয়তো আসবে, সামলে নেব। কিন্তু এখন এমন পরিস্থিতি এসেছে, মনে হয় যেন আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন, ভাষা বিপন্ন, সংস্কৃতি বিপন্ন, চিন্তা শক্তি যেন অন্য কারো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, মিথ্যে মিথের ভারে সত্য প্রায় বিলুপ্ত- পথ খোঁজার আশায় শরণাপন্ন হয়েছি  রবীন্দ্রনাথের। কথায় বলে না, আমরা ভাববার আগেই উনি লিখে বসে আছেন সব। 

তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী পড়লে জানা যায় যে রবীন্দ্রনাথ প্রাদেশিকতা এবং জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিলেন।  শুধু এই তথ্যটাকে টুকরো ভাবে ভুল উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।  তাঁর মতে এই “নেশন” বস্তুটাই  পশ্চিমের আবিষ্কার।  “ভারতবর্ষ বহু জাতি উপজাতি , বহু ভাষাভাষী অধিবাসীর বাসভূমি। নেশনের কল্পনা সে কখনো করে নাই- ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজের মধ্যে মানুষ বাস করিয়া আসিয়াছে এই জন্যে ভারতবর্ষবাসীরা ইতিহাস নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি।  ভারত বারবার আক্রান্ত হয়েছে বটে, কিন্তু আক্রমণকারীরা অচিরেই ভারতবর্ষে মিশে গিয়ে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারিয়েছে।  “হে মোর চিত্ত পুণ্যতীর্থে জাগো রে ধীরেগানটা তো অনেকেই জানে- তা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ “Nationalism” এবং “Personality” ওপর বহু প্রবন্ধ লিখেছেন এবং বক্তৃতা দিয়েছেন।  তিনি আবার “individualism” ও “ personality” তফাৎ দেখিয়েছেন-individualism এ স্বার্থবোধ, বৃহত্ত্ববোধ উৎকট ভাবে প্রবল কিন্তু personality র মধ্যে আত্মবোধ ও বিশ্ববোধ সুন্দর ভাবে প্রকাশিত।  তিনি বলেছেন, nationalism আসলে ওই individualism-এরই রকমফের- কিছু মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির কারণে অন্য নেশনের ক্ষতি করার জন্য যুদ্ধ ইত্যাদি করে, প্রাণ যায় তার নিজের দেশের তরুণবাহিনীর। 

এসব কথা তিনি প্রথমে লিখেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায়, তার পর স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে এই কথারই রকমফের প্রতিধ্বনিত করেন বারবার।  বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আগে ভারত আন্দোলনও করতে জানত না। বাঙালির অস্তিত্ব, বাঙালির ভাষার ওপর বিভাজনের কোপ পড়ছে দেখে রবীন্দ্রনাথ ও পথে নেবে নেতৃত্ব দিলেন।  এখানে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ “প্রাদেশিক” নন সেই অর্থে। কারণ এখানে স্বার্থ নেই, আত্মরক্ষা আছে।  এই সময়ে তিনি কংগ্রেস অধিবেশন ইত্যাদিতেও গেছেন, কিন্তু তার পর নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন প্রত্যক্ষ রাজনীতি অর্থাৎ চলতি কথায় আমরা যাকে পার্টি পলিটিক্স বলি, তার থেকে।  অন্তত দুটো কারণ চিহ্নিত করা যায় তার। প্রথমত, নেতাদের মধ্যে সন্দীপকে খুঁজে পাওয়া, এবং দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ জানতেন ব্রিটিশের কাছে আবেদন নিবেদন করে কোনও ফল হবে না, ব্রিটিশ ভারতে যতটুকু নিজের স্বার্থসিদ্ধি, তার বাইরে এক বিন্দুও কিছু দেবে না ভারতীয়দের।


বাইশে শ্রাবণে তিনি তো রয়েই গেলেন সুস্মিতা ঘোষ | 08-08-2022

এখানেই রবীন্দ্রনাথ বাকি সকলের থেকে আলাদা।  

এই কারণেই মন্টেগু কমিশনের রিপোর্ট দেখে যখন গান্ধীজির নেতৃত্বে সারা দেশ বিশ্বাস করল যে এক বছর কষ্ট করে বিদেশী বর্জন এবং আন্দোলন করে গেলে স্বরাজ নিশ্চয়ই আসবে এমনকী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো মানুষ ও বিশ্বাস করলেন স্বরাজ আসছে এ বছরে, তখন একমাত্র রবীন্দ্রনাথের দূরদৃষ্টি তাঁকে তা বিশ্বাস করতে দেয় নি।  তিনি বারবার বলেছিলেন খাদি আন্দোলন, স্কুল কলেজ বর্জন এই সবে জন সাধারণের ক্ষতিই হচ্ছে, কারণ এতে স্বরাজ এখন আসবে না। বরং এই সব করে আসল লক্ষ্য যেটা হওয়া উচিত ছিল, “স্বাধীনতা”, সেটার থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়া হচ্ছে।  এর মধ্যে খিলাফত আন্দোলনকে জড়িয়ে ফেলারও তিনি তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেছিলেন, হিন্দু ও মুসলমান কিন্তু ভিন্ন, পরস্পরকে ভাল করে জানলে বুঝলে তবেই মৈত্রী আসবে, একসঙ্গে কাজ করলে ফল পাওয়া যাবে, কিন্তু না বুঝেই জোর করে বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে একত্র করা চেষ্টা করলে তার ফল একেবারেই ভালো হবে না। “যে রীতিমতো জ্ঞানশিক্ষা দ্বারা ধর্মান্ধতার আরোগ্য ঘটে তা ছাড়া উপায় নেই”, বলেছিলেন তিনি।  কিন্তু পোড় খাওয়া পলিটিশিয়ানের বদলে তাঁর গায়ে যে গগনবিহারী কবির ছাপ! তাঁর কথা কেউ শুনল না। এবং নতুন ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় তা প্রথম এই সময়েই শুরু হয়।  

রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাগ্নী সরলা দেবী উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্ববাদ প্রচারে নামলে তিনি তাঁকে নানাভাবে বারণ করেছেন।  যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের মুঘল বিরোধী দিকটার পরিপ্রেক্ষিতে সরলা দেবী “প্রতাপাদিত্য উৎসব” করার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি বলেছিলেন, ওরে লোকটা খুনি, অত্যাচারী রাজা ছিল। “বউ ঠাকুরানীর হাট” উপন্যাসে তো এসব ইতিহাস তিনি লিখেই গেছেন। জনগণ যাতে আরও ভালভাবে সেটা বুঝতে পারেন, তাই এর নাট্যরূপ দিয়ে করেছিলেন “প্রায়শ্চিত্ত”। অসহযোগ আন্দোলনের প্রায় সমসাময়িক কালেই বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্ৰহ করতে রবীন্দ্রনাথ অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করিয়েছেন দেশে বিদেশে। তার একটি, বর্ষামঙ্গল, অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই সময়েই কলকাতায়।  এই দেখে সরলা দেবী নানা রকম কটূক্তি করেন, যার মর্মার্থ হল দেশের লোক স্বরাজের জন্যে আন্দোলন করে পথে বসেছে, আর উনি এখন গান বাজনা করছেন।  রবীন্দ্রনাথ এর জবাব দিয়েছিলেন এই বলে যে, যখন মন অশান্ত, তখন গানই মনকে শান্ত করে।  এর পরে তিনি দেশে বিদেশে নানা স্থানে গানের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও বক্তৃতা করেছেন।  সরলা দেবীর মতো আরো নেত্রী নিশ্চয়ই তখন বাংলায় ছিলেন। “নামঞ্জুর গল্প”-র অমিয়ার মধ্যে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়।  

রবীন্দ্রনাথের কম বয়সে নেওয়া অনেক সিদ্ধান্ত, বা প্রকাশ করা অনেক মতবাদ পরে ভুল হয়েছে মনে হলে তিনি সংশোধন করে নিয়েছেন বারে বারে।  বঙ্গভঙ্গের পর পার্টি পলিটিক্স থেকে সরে আসার কথা তো আগেই বলেছি।  রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় “শিবাজী উৎসব” কবিতাটি সখারাম দেউস্কর এর বইয়ের মুখবন্ধ হিসেবে প্রকাশ করার পর তিনি দেখলেন যে তাঁর এই কবিতাটি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার হচ্ছে।  তিনি এই কারণে কবিতাটি কোনও বইতে সংকলন করে যাননি।  কবিতাটি আবার কী করে ঠিক একই ভাবে অপব্যবহার শুরু হল, তা এক পৃথক গবেষণার বিষয়।

রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনির আমন্ত্রণে ইতালি গিয়েছিলেন, তাঁকে যা যা দেখানো হয়েছিল, এবং যেমন সাদর অভর্থ্যনা পেয়েছিলেন, তাই দেখে তো তখন মুসোলিনির প্রশংসাই করেছিলেন।  তারপর য়ুরোপের অন্য অন্য দেশে গিয়ে ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির স্বরূপ জানতেই তিনি মুসোলিনির নীতির কঠোর সমালোচনা করেন।  তাঁর রাশিয়া ভ্রমণও ঠিক এই রকমই।  বলশেভিক বিপ্লবের পর ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়ানো রাশিয়াকে দেখে তিনি মুগ্ধ ছিলেন ততক্ষণই যতক্ষণ তিনি  রাশিয়ার মাটিতে।  সেখান থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনের মধ্যে থেকে যাওয়া খটকাটা পরিষ্কার হল- তিনি লিখলেন, এ সাম্যবাদ চাপিয়ে দেওয়া- মানুষের নিজস্ব প্রবৃত্তির বিরোধী। স্বল্পকালের জন্য সুফল হলেও দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া যাবে না।

রবীন্দ্রনাথকে সবাই সুবিধা মতো ব্যবহার করে। যেমন, তাঁর রক্তকরবী, মুক্তধারা অনেক রাজনৈতিক দলই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেই 1926 সালেই কবি বলেন যে, “আমাদের নকল-নিপুণ মন ফাসিজম, বলশেভিসম প্রভৃতি মতবাদ দেশের সমাজ দেহে আমদানি করিবার জন্য আন্দোলনে প্রবৃত্ত। আজ যখন শুনে এলুম সাহিত্যে ইশারা চলছে- মহাজনকে লাগাও বাড়ি, জমিদারকে ফেলো পিষে, তখন বুঝতে পারলুম, এই লালমুখো বুলির উৎপত্তি এদের নিজের রক্ত থেকে নয়; এ হচ্ছে বাঙালির অসাধারণ নকলনৈপুণ্যের নাট্য, মাজেন্টা রঙে চোবান। এর আছে উপরে হাত-পা ছোঁড়া, ভিতরে চিত্তহীনতা।” এ ছাড়াও “চার অধ্যায়” তো আরও অনেক কিছু বলে - অতীন কী ধরণের নেতা!   

রাজনীতি নিয়ে নিজের মতামত আমি একেবারেই দিতে চাই না, কারণ তা অনধিকার চর্চা হয়ে যাবে কিন্তু একটা নিজস্ব মত না দিয়ে পারছি না। রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টিতে তিনি খাঁটি এবং মেকির তফাৎ সহজেই বুঝতেন, মেকি স্বার্থসিদ্ধিকারীদের থেকে তিনি দূরেই থাকতেন।  গান্ধীজি সম্বন্ধে নানা সমালোচনার মধ্যে অনেকে তাঁকে “চতুর বানিয়া” ইত্যাদি স্বার্থসিদ্ধিকারী বদনাম দিয়ে থাকে।  গান্ধীজির সব স্ট্রাটেজি ঠিক ছিল না তো রবীন্দ্রনাথ নিজেই দেখতে পেয়েছেন, প্রতিবাদও করেছেন।  কিন্তু গান্ধীজি যদি সত্যি সত্যি “চতুর বানিয়া” হতেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সংস্রব অনেক দিন আগেই ত্যাগ করতেন - কারণ এখানে তাঁর হারানোর কিছু ছিল না।  

নারী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি দেখেও আমি অবাক হয়ে যাই।  কেউ যেন আবার কেন বাচ্চা বয়সে মেয়েগুলোর বিয়ে দিয়েছিলেন প্রসঙ্গ তুলবেন না। ওই কাজ গুলো ভুল হয়েছিল, তার মূল্য তো তাঁর চেয়ে বেশি কাউকে দিতে হয় নি! 

অনেকের কাছে শুনি “রবীন্দ্রনাথ তেমন বোল্ড হতে পারলেন না!” কেন? না, বিনোদিনীর তিনি কেন কাশীবাস করালেন! বিনোদিনী রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী  - ভাগ্যবিপর্যয়ে তার ঘর বর জোটে নি, কামনা বাসনার চরিতার্থ করার জন্য যে দুটি পুরুষ জুটল, তাদের কোনো মেরুদণ্ড নেই।  এরকম পুরুষ কাঁহাতক ভাল লাগে! তাই তাদের ছেড়ে কাশী চলে যাওয়ার মধ্যে আমি তো কোনও অসঙ্গতি দেখি না।  কাশীতে গিয়ে সে কী করেছিল সেটা রবীন্দ্রনাথ লিখে যাননি। অত গুণী মেয়ে কোনো গঠনমূলক কাজে শান্তি তো পেতেই পারে! এটা ১৯০৩ সালের লেখা।  তার 11 বছর পরে স্ত্রীর পত্রের মৃণাল ত্যাগ দিচ্ছে স্বামীকে।  এর চেয়েও বোল্ড তো হল যোগাযোগ! যা হল কুমুদিনীর শরীর ও মনের অধিকার নিয়ে।  সে ইম্প্র্যাক্টিক্যাল বটে, কিন্তু শিক্ষিতা - তার শরীর ও মন সে চায় ধাপে ধাপে স্বামীকে উৎসর্গ করতে। কিন্তু স্বামী তার আগেই জোর করে তার শরীরের দখল নিচ্ছে- এতো marital rape ! রবীন্দ্রনাথ পুরুষ মানুষ হয়ে 1926 সালে তা বেশি কথা খরচ না করেই বুঝিয়ে গেছেন! অথচ  আজ প্রায় একশো বছরে পরেও না দেশের সংসদে জনপ্রতিনিধি পুরুষ এবং নারীরা, না জনতার মতামতের থেকে সুরক্ষিত দেশের বিচারব্যবস্থা তা স্বীকার করতে পারল!  

দূরদৃষ্টির আরও উদাহরণ আছে। 1925 সাল নাগাদ তিনি জাপান থেকে জুজুৎসু বিশেষজ্ঞ তাগাহাকিকে আনিয়ে ছিলেন বিশেষ করে মেয়েদের আত্মরক্ষা শিক্ষার জন্যে।  দু বছরে বিশ্বভারতীর সেই যুগে 14,000 টাকা খরচ হয়েছিল।  খুব বেশি লোক শিখল  না , মেয়েরা তো শিখলই না।  এমনকী কলকাতায় জুজুৎসুর একটা শো করা হয়েছিল, লোক হয়নি।  পরের চার দিন “নবীন” নৃত্যনাট্যের শো হাউসফুল গেছে!  

বনফুল রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই যে মেয়েদের এত নাচ শেখাচ্ছেন, এর ভবিষ্যৎ কী? সেই তো বিয়ের পর নাচ টাচ সব ছেড়ে দেবে।  রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, এমন একদিন আসবে, যখন মেয়েরা নাচ গান শিখিয়ে সংসার প্রতিপালন করবে।  সেদিন তো অনেক দিনই এসে গেছে। রবীন্দ্রনাথের আর সব সৃষ্টির মতোই  তাঁর গান, তাঁর নাচ অনেকেরই জীবিকা। 

কিন্তু একটা ছোট্ট তফাৎ আছে।  কেউ বোঝে না তাঁরে। বুঝলে তাঁর গান তাঁদের জীবিকার সঙ্গে সঙ্গে জীবনে শান্তিও আনত  “গীতাঞ্জলিই আমার গীতা” - এটা অনেকেই মুখে বলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দর্শনে পথ চলেন না। যে দর্শনে তিনি মুনাফাতন্ত্র থেকে সভ্যতাকে বাঁচাতে বলেছেন।   

সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল। 

 আপনি কেটেছে আপনার মূল - না জানে সাঁতার নাহি পায় কূল। 

স্রোতে যায় ভেসে, ডোবে বুঝি শেষে, করে দিবানিশি টলোমল।

#AzadiKaAmritMahotsav #HarGharTiranga #RabindranathTagore #Baishe_Shraban



New
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
বিদায় পিটি নায়ার: কলকাতার ইতিহাসবেত্তা
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
এগজিট পোল মিলে গেলেও যে প্রশ্ন উঠবেই
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?
কংগ্রেস সেঞ্চুরি না করলে কে রুখবে বিজেপিকে?


Other Writings by -সুস্মিতা ঘোষ | 08-08-2022

// Event for pushed the video