স্বাধীনতার সময়কার কথা দিয়ে শুরু করতে গেলে বলতে হয়, সারা দেশে তখন অগ্রণী স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। গত কয়েক বছরে রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থার বেশ কিছুটা উন্নতি হলেও 75 বছর আগেকার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে গেলে কিন্ত এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।
সার্বিক ভাবে স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক পরিসরে সুস্থ ও ভাল থাকাকে বোঝায়। ভারতে স্বাস্থ্যপরিষেবা সংক্রান্ত কাজকর্ম সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের (কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার) উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার অধিকারকে সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি। এই অবস্থায় স্বাধীনতার 75বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার হাস একটু খতিয়ে দেখা দরকার।
মনে রাখতে হবে, দেশ যখন স্বাধীন হয় 1947 সালে, তখন দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল 32 বছর, 2018 সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে 69 বছরে। সন্দেহ নেই, দেশের স্বাস্থ্য চিত্রে এটা একটা বিরাট অগ্রগতি। 1950-51 সালে দেশে সাকুল্যে মাত্র 28টি মেডিকেল কলেজ ছিল, এখন 2020 সালের হিসাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে 542টিতে। 2017 সালে প্রকাশিত জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে বলা হয়েছিল, রাষ্টের তরফে স্বাস্থ্য খাতে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের (GDP) 2.5% বরাদ্দ করতে হবে। অথচ 2019 সালেও দেখা যাচ্ছে, বরাদ্দ ছিল মাত্র 1.2% অর্থ। 2020-21 সালে অবশ্য বরাদ্দ কিছুটা বেড়ে 2.1% হয়েছে। মনে রাখতে হবে একই সময়ে (2021) দেশের প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়েছিল GDP-র 2.7%, অর্থাৎ স্বাস্থ্যের বরাদ্দের চাইতে বেশি। দেশের সুরক্ষার জন্যই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত রাখতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের গুরুত্বকে অস্বীকার না করেই প্রশ্ন তোলা যায়, রাষ্ট্র কেন স্বাস্থ্যের চাইতে প্রতিরক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেবে? অনেকের কাছেই এই প্রশ্নটি অর্থবহ বলে মনে হয়।
স্বাস্থ্যের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে তাকানো যাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে জনসংখ্যার সঙ্গে চিকিৎসকদের সংখ্যার অনুপাতটা হওয়া উচিত প্রতি 1:1000,অর্থাৎ প্রতি 1000 জন মানুষ পিছু একজন করে টিকিৎসক থাকা দরকার। কিন্থু ভারতে এই অনুপাতটা প্রতি 1511 জন মানুষের জন্য একজন করে চিকিৎসক। একইভাবে হাসপাতালের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে প্রতি 1000 জন মানুষের জন্য হাসপাতালে অন্তত 5টি করে শয্যা থাকা দরকার। ভারতে এই হার অনেয্ক কম, প্রতি 1000 জন মানুষের জন্য 0.55 হারে শয্যা রয়েছে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের অপ্রতুলতাও খুবই উদ্বেগজনক। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেশের গ্রামাঞ্চলে, সেখানে চিকিৎসকের ঘাটতির হার 78.9%। আবার সাধারণ চিকিৎসক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের ঘাটতি 78.2%, প্রসূতিবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের ঘাটচি 69.7%।
দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার চিত্রে পশ্চিমবঙ্গের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। স্বাধীনতার আগে ও পরে চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গে খুবই উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এদের বেশ কয়েকটিই জাতীয় প্রেক্ষিতে তাদের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। 1932 সালে রকফেলার ফাউন্ডেশনের অর্থানুকূল্যে অল ইণ্ডিয়া ইনস্টিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ কাজ শুরু করে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পড়ানো, প্রশিক্ষণ দেওয়া ও গবেষণার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠান গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম কাজ শুরু করে। 1944 সালে এই প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গের 68টি গ্রামের 7000 মানুষকে নিয়ে প্রথম জনসমীক্ষা করে। একই সময়ে Sir Joseph Bhore সিঙ্গুরের গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সমীক্ষা চালিয়ে কী করে ভালোভাবে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে তার সুপারিশ করেন। ঔপনিবেশক শাসনের কালে এবং পরে স্বাধীন ভারতে এই প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য বিষয়ে বেশ কিছু কাজ করে, যা আগে ভারতে করা হয়নি। এখন সেই ধরণের উদ্যোগ তএমন চোখে পড়ে না।
1922 সালে কলকাতার বুকে যে স্কুল অব ট্রপিকাল মেডিসিন স্থাপিত হয়েছিল, তার কৃতিত্ব অবশ্যই Leonard Rogers কে দিতে হবে। ইণ্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসের এই সদস্য তখন বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজের প্যাথলজির অধ্যাপক ছিলেন। 1922 সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথম ব্যাচের ছাত্ররা ডিপ্লোমা নিয়ে বেরিয়ে আসে। সেখানে অধ্যাপনা করতেন Ronald Ross, U N Brahmachari এবং R N Chopra-র মতো গুণী বিজ্ঞানীরা। এই প্রতিষ্ঠানে এখনও ছাত্রদের পড়ানো ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে চলেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
1835 সালের 28 জানুয়ারি ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হয়। তখন লর্ড বেন্টিঙ্কের শাসনকাল। সেটাই ছিল গোটা এশিয়ার মধ্যে প্রথম মেডিক্যাল কলেজ। তার অনেক পরে 1860 সালে লাহোরে কিং এডওয়ার্ড নেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়। স্বাধীনতার অবব্যহিত পরেও ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ গোটা দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে ছিল। এখন 2021 সালে তার অবস্থান অনেক নিচে, 32 তম স্থানে। যদিও সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে এই ক্রম অবস্থান খুব একটা খারাপ নয়, তবুও এটা মানতেই হবে যে 1947 সালের তুলনায় এই অবস্থান অনেকটাই নিম্নগতির ইঙ্গিত দেয়।
একদা বিশিষ্ট বলে খ্যাত চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিউইউট 1950 সালের 2 জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। গোট দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য যে 25টি আঞ্চলিক কেন্দ্র তৈরি করা হয়, এটি তাদের মধ্যে অন্যতম। এর যাবতীয় ব্যয়ের 75% কেন্দ্রীয় সরকার এবং 25% রাজ্য সরকার বহন করে থাকে। কোনও সন্দেহ নেই যে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এটি দেশের মধ্যে ক্যান্সার চিকিৎসার অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য হত। কিন্তু গত মুম্বইয়ে টাটা মেমোরিয়ালের মতো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি হওআর পর রোগীদের মধ্যে গত কয়েক দশকে ওই সব জায়গাতেই ছোটার প্রবণতা বেড়েছে। চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এখন কলকাতার উপকণ্ঠে রাজারহাটে একটি নতুন শাখা হাসপাতাল চালু করেছে। এখন যেটা দেখার তা হল, তারা তাদের হৃতগৌরব কতখানি পুনরুদ্ধার করতে পারে।
#AzadiKaAmritMahotsav #Health_Services_India #Bengal_at_Independence