আমরা যারা গত শতকের মাঝামাঝি জন্মেছিলাম, তারা ভোটাধিকার পেতাম একুশে পা দিলে। আমি একুশে পৌঁছবার আগেই 72-এর বিখ্যাত(?) ভোটটি হয়ে গিয়েছিল। আর আমার একুশ ছোঁয়ার পরবর্তী ভোট আসার আগেই প্রশাসনের অঙ্গ হয়ে গেছি। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে যখন নাম লেখাই আমি স্বাধীনতা তখন সদ্য রজত জয়ন্তী অতিক্রম করেছে, মোটে 26/27 বছরের যুবক।
প্রথম ভোট দেওয়ার উত্তেজনা একদমই টের পাইনি কারণ সাবালকত্ব পাওয়ার পরে যে ভোটটা পেলাম সেটা জরুরি অবস্থা ওঠার ঠিক পরে 77-এর ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টানো ভোট। ততোদিনে আমি প্রশাসন যন্ত্রের অন্যতম বল্টু হয়ে লোকসভা কেন্দ্রের সহকারী রিটার্নিং অফিসার। তালেগোলে এবং প্রথম ভোট পরিচালনার টেনশনে আমার নাম যেখানে চাকরি করি সেখানকার ভোটার তালিকায় তোলাই হয়নি।
এই প্রায় অর্ধশতাব্দী কালে অনেক কিছুই বদলে গেছে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান এবং প্রক্রিয়ার বেড়ে ওঠায় আমি সবচেয়ে চমৎকৃত সেটি হল এই বিশাল দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া।
1977 সালের ভোটের নির্দেশাবলি সম্বলিত পুস্তিকাবলি, যেগুলোকে ‘হ্যান্ডবুক’ বলা হয়, সেগুলো বেশ তণ্বী সুন্দরী ছিল। বোধহয় গোটা দুয়েক বই ছিল, একটা রিটার্নিং অফিসারদের জন্য, আরেকটা প্রিসাইডিং অফিসারদের। প্রথমটা শদুয়েক পাতার, অন্যটা গোটা পঞ্চাশেক পৃষ্ঠার। আর ছিল একটা ‘ম্যানুয়াল অফ ইলেকশন লস’। সেটা অন্য বইগুলোর তুলনায় বেশ মোটাসোটা। সংবিধানের নির্বাচিত অংশ, তার সঙ্গে যে যে অ্যাক্ট এবং রুল দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়, সেগুলোর সঙ্কলন। এই মোটা বইটা খটকা লাগলে খুলতে হত, হ্যাণ্ডবুক দুটোর মতো নিত্য ব্যবহার্য ছিল না। এগুলোর পেছন পেছন ঢুকতো খসখসে কাগজে, ধ্যাবড়া করে সাইক্লোস্টাইলে ছাপা কিছু আদেশনামা, প্রক্রিয়ার বিশদ ব্যাখ্যা জাতীয়। ছাপা এবং কাগজের গুণে সেগুলোর অর্ধেক পড়া যেত, বাকি অর্ধেক আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বুঝে নিতে হত।
মোবাইল, ইন্টারনেট বিহীন সেই কালে ভোটকর্মীরা স্থানীয় ভাবে নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনায় যে সিদ্ধান্ত নিতেন সেটাই আইন হয়ে দাঁড়াত তখনকার মতো। এসটিডিও ছিল না তখন। শিলিগুড়ি থেকে ট্রাঙ্ক কল বুক করে জেলা সদর দার্জিলিং, কিম্বা মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দপ্তর কোলকাতায় ফোন পেতে পেতে আর এক বার দাড়ি কামানোর সময় হয়ে যেত। সমস্যার জটিলতা বুঝে আপৎকালে কর্তারা শুনতে পেতেন অথবা পেতেন না। ধরুন এদিক থেকে বলা হল, ‘এখানে খুব পাবলিক টেনশন হচ্ছে স্যার’, ওপার থেকে উত্তর এল, ‘খুব বৃষ্টি হচ্ছে? রিলিফের ত্রিপলগুলো ব্যবহার করুন’।
তারপর থেকে প্রতি নির্বাচনেই দেখেছি হ্যাণ্ডবুকগুলো পৃথুলা হয়ে উঠছে, যৌবন পার করে মধ্যবয়সে পৌঁছে মনুষ্যকূলের যেমন হয়ে থাকে। চাকরি জীবনে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বের পর্ব শেষে করে ভিন রাজ্যে নির্বাচন পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব যখন থেকে চাপতে শুরু করল তখন নির্বাচন কমিশন আর এগুলোর মুদ্রিত সংস্করণ দিত না। একটা করে সিডি ধরাত। তত দিনে তারা যে আকার ধারণ করেছিল তাতে সেগুলিকে আগের মত ছাপা সংস্করণ দিতে হলে , সংশ্লিষ্ট সবাইকে সেগুলো বইবার জন্য একটা করে গাধাও দিতে হত। হ্যাণ্ডবুক সংখ্যাতেও বাড়তে থেকেছে ক্রমান্বয়ে। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী এখন 26টি হ্যাণ্ডবুক আছে নানা বিষয়ে, অবজার্ভার, ক্যাণ্ডিডেট, মিডিয়া, ভোটার মডেল কোড অফ কনডাক্ট, কাউন্টিং অফিসার, প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে নির্দিষ্ট বিষয়গুলি গুছিয়ে লেখা। ভোটারদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা হয় নানারকম। বিশ্বের নানা গণতান্ত্রিক দেশ নিয়মিত পরামর্শ চেয়ে থাকে ভারতের নির্বাচন কমিশনের।
2019 সালে ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল 90 কোটি ভারতীয়ের, ভোটার সংখ্যায় পৃথিবীর বৃহত্তম। (1952-র প্রথম নির্বাচনে দেশে 17 কোটি ভোটার ছিলেন)। এঁদের 46.5 কোটি, 43.2 কোটি মহিলা আর 38325 জন ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের। 39 লক্ষ 60 হাজার ইভিএম বসেছিল 10,35,918 পোলিং স্টেশনে। 2.70 লক্ষ প্যারামিলিটারি ফোর্স আর 20 লক্ষ রাজ্য পুলিশ।2019এর ভোট কর্মীর সঠিক সংখ্যাটা পেলাম না, 2014 তে যাঁরা কেবল পোলিং বুথ সামলেছিলেন তাঁদের সংখ্যা ছিল 37,31,897 জন। বিভিন্ন স্তরের সহায়ক কর্মচারী ও আধিকারিকদের ধরলে সংখ্যাটা পঞ্চাশ লক্ষের কাছাকাছি হবে বলে আমার ধারণা। সংখ্যাগুলো বিশাল।
পলিটিক্যাল পার্টি কিন্তু নির্বাচন কমিশনেরই অবদান
বারবারই মনে করিয়ে দেন সমাজবিজ্ঞানীরা যে কেবল নির্বাচনই সুষ্ঠু গণতন্ত্রের একমাত্র লক্ষণ নয়। এ নিয়ে কোন তর্ক নেই আমার সঙ্গে। কিন্তু এই বিশাল দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনেক দিন নানা ভূমিকায় দেখাতে পাওয়ার সুবাদে আমার মনে হয়েছে যে গণতন্ত্রের এই ‘নেসেসারি বাট নট সাফিসিয়েন্ট’ প্রক্রিয়াটি যে ভাবে নিজেকে পরিমার্জন পরিবর্ধন করতে করতে এগিয়েছে সেটাও খুব ছোট কৃতিত্ব নয়।
একটা ব্যাপার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। সেটা এই যে ভারতীয় সংবিধানে কোথাও রাজনৈতিক দলের কোনও উল্লেখ ছিল না প্রথমে। আস্ত একটা পরিচ্ছেদ প্রথম থেকেই আছে নির্বাচনের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে কিন্তু গনতন্ত্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ রাজনৈতিক দলগুলি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। এই নীরবতা কেন তারও কোনও ব্যাখ্যা পাইনি। সংবিধানে রাজনৈতিক দলের উল্লেখ করা হয়েছিল সংবিধান রচনার বহু পরে, 1985 সালের সংবিধান সংশোধনী আইনের মাধ্যমে যখন দশম তফশিলটি যোগ করা হয়েছিল। সেখানেও উল্লেখ করা হল বটে কিন্তু রাজনৈতিক দল বলতে কী বোঝায় তার কোনও সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। 1951 সালের রিপ্রেজেন্টেশন অফ পিপলস অ্যাক্টেও কোনও উল্লেখ ছিল না পলিটিকাল পার্টির। এই শব্দবন্ধটি ওই অ্যাক্টে ঢুকেছিল 1989 সালের একটি স্ংশোধনী মারফৎ।
স্বাধীনতার পরের প্রথম নির্বাচন থেকেই কোন রাজনৈতিক দল কোন স্তরের দল রূপে গণ্য হবে তা ঠিক করেন নির্বাচন কমিশন। এই স্বীকৃতি দেওয়ার কোনও নির্দিষ্ট আইনি ব্যবস্থার অনুপস্থিতে সংবিধানের আর্টিকেল 324 এবং রিপ্রেজেন্টেশণ অফ পিপল (কনডাক্ট অফ ইলেকশন) রুল 1951য় প্রদত্ত সার্বিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে কোন দল জাতীয় স্তরে স্বীকৃতি পাবে আর কারা স্থানীয় তা প্রথম থেকেই নির্ধারন করেন নির্বাচন কমিশন।
গত 75 বছর নির্বাচন প্রক্রিয়া নিজেকে পরিমার্জন করতে করতে এগিয়েছে
যেমন 1968 সালের 31শে আগস্টে নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে জারি করা দ্য ইলেকশন সিম্বলস (রিজার্ভেশন অ্যাণ্ড অ্যালটমেন্ট) অর্ডার 1968 এরকমই একটা মাইলফলক, কেবল রাজনৈতিক দলগুলির জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাপনাতে একটা বড় উদ্ভাবন।
1977 সালের প্রথমে সংসদ, এবং পরে বিধানসভা নির্বাচন দিয়ে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল নির্বাচন প্রক্রিয়ায়। তার অনেক পরে 1994 সালে সবখানে চালু করা হল ভোটারদের ফটো আইডেনটিটি কার্ড, যেটি এখন EPIC নামে পরিচিত। কিন্তু উদ্যোগটা বেশ পুরনো। প্রথম পাইলট করা হয়েছিল কলকাতা দক্ষিণ পশ্চিম লোক সভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে, 1960 সালে। 3.42 লক্ষ ভোটারের মধ্যে ছবি তোলা হয়েছিল 2.13 লক্ষ ভোটারের, আর কার্ড দেওয়া হয়েছিল 2.10 লক্ষ ভোটারকে। সফল হয়নি এই পাইলট। অনেক পরে 1979 সালে সিকিমের ভোটে সফল ভাবে বিতরণ করা হল ভোটার কার্ড। তারপর উত্তর পূর্ব ভারতে অসম, মেঘালয় এবং মণিপুরে। 1994 সাল থেকে এটি দেশ জুড়ে প্রবর্তিত হল।
অবজার্ভার বা নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা মাঠে নামলেন সম্ভবত 80র দশক থেকে। তখন রাজ্য স্তরের সিনিয়র আইএএস অফিসারদের এই দায়িত্ব দেওয়া হতো তাঁরা যে রাজ্যের ক্যাডারে আছেন, সেই রাজ্যেই। এতে পর্যবেক্ষণ যতটা নিরপেক্ষ হলে ভাল হত ততটা হতে পারতো না। টি এন শেষন মুখ্য নির্বাচনী কমিসনার হওয়ার পর, এবং এই সঙ্গে পার্লামেন্টে 1990 সালে দীনেশ গোস্বামীর কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষকরা ভিন রাজ্যে দেখতে শুরু করলেন।
দলিত এবং জনজাতির প্রান্তিক মানুষদের ওপর প্রার্থী বিশেষকে ভোট দেওয়ার বা না দেওয়ার জন্য উৎপীড়ন ভারতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ার একটী প্রাচীন ব্যাধি। এই অত্যাচারকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হল সিডিউলড কাস্টস অ্যান্ড ট্রাইবস (প্রিভেনসন অফ অ্যাট্রোসিটিস ) অ্যাক্ট 1989 এ। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সশক্তিকরণে এটাও একটা মাইলফলক।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সংস্কারে সবচেয়ে আলোচিত নাম টি এন শেষন। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য হলেও মিডিয়া তাঁর উত্তর এবং পূর্বসূরীদের তুলনায় তাঁর প্রতি একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। তার কারণ সম্ভবত এই যে রাজনৈতিক পদাধিকারীদের সঙ্গে তাঁর সঙ্ঘাতগুলিকে তিনি যতটা প্রচারের আলোয় আনতেন, অন্যরা সেটা থেকে বিরত থাকতেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে শেষণের নিরন্তর সঙ্ঘাতের অন্যতম ফসল আজকের একাধিক সদস্য বিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন। কমিশনের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর পেছনে রাজনৈতিক নেতাদের যুক্তি ছিল এত বড় দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কেবল একজন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হাতে ছেড়ে রাখা ঠিক নয়। 1993 সালে প্রধাবমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাও মুখ্য কমিশনার ছাড়াও আরও দুজন কমিশনার নয়োগ করলেন, অবসরপ্রাপ্ত আইএএস এম এস গিল, আর ল কমিশনের প্রাক্তন সদস্য জি ভি জি কৃষ্ণমূর্তি। এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন শেষন। নিষ্পত্তি হল 1995 সালে, যখন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন বিচারকের বেঞ্চ রায় দিল কৃষ্ণমুর্তি এবং গিলের নিয়োগ আইনসঙ্গত।
শেষনের আর একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার পর নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত সব সরকারি আধিকারিকের ওপর কমিশনের কর্তৃত্ব আক্ষরিক অর্থে কায়েম করা। আজকে যে নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার পর কোনও রাজ্যের মুখ্য সচিব সহ বিভিন্ন স্তরের সরকারি আধিকারিকদের অস্থায়ীভাবে হলেও বদলে দিতে পারেন কমিশন, সেই অধিকারটা তৎকালীন সরকারের সঙ্গে অনেক লড়ে আদায় করেছিলেন শেষন।
মডেল কোড অফ কনডাক্ট বা নির্বাচন আচরণবিধির দৃঢ়ভাবে প্রয়োগ করতে শুরু করার কৃতিত্বও শেষনের। এই আচরণবিধি প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেরাই তৈরি করেছিলেন, 1960 সালে কেরলের বিধানসভায় সাধারণ নির্বাচনের সময়। মুলতঃ নির্বাচনের সময় সব পক্ষ মেনে চলবে এরকম একটি একটি ডু অ্যান্ড ডোন্টের লিস্ট। ক্রমে ক্রমে এটি কমিশনের নিজস্ব কোড হয়ে ওঠে। প্রায় প্রতি ভোটের পরেই বেস্ট প্র্যাকটিসগুলো তুলে নিয়ে এসে পরিমার্জন করা হয় এই কোডের। আইন নয়, অথচ আইনের মতোই জোরাল ভাবে প্রয়োগ করা হয় এই কোডটি।
নির্বাচনের সময়ে কমিশনের আধিপত্য বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শেষনের কোনও কোনও সমালোচক তাঁকে অ্যালসেসিয়ান নামে ডাকতে শুরু করেছিলেন। অন্যদিকে শেষনও ঘোষণা করেছিলেন, "আই হ্যাভ পলিটিসিয়ানস ফর ব্রেকফাস্ট।" শেষন নিঃসন্দেহে নির্বাচনের ইতিহাসের এক বর্ণময় অধ্যায়। নির্বাচনে যাতে সরকার বা বিরোধী কোনও পক্ষই বেশি সুবিধা না পেতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে তিনি বহুলাংশে সফলও হয়েছিলেন।
শেষনের উত্তরসূরিরাও চেষ্টা করেছিলেন সংস্কারের প্রক্রিয়াটা অব্যাহত রাখতে। কিছু সাফল্য পেলেও তাঁদের বেশ কিছু উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল। যেমন এম এস গিল প্রস্তাব করেছিলেন আইনটা সংশোধন করার, যাতে ক্রিমিনাল কেসে অভিযুক্তরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতে পারেন। সরকার গ্রহণ করেনি সে প্রস্তাব। কমিশনের অন্য একটি প্রস্তাব ছিল রাজনৈতিক দলগুলির হিসেব পত্রও কন্ট্রোলার এবং অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার মনোনীত সংস্থা দ্বারা নিরীক্ষিত হোক। এই প্রস্তাবটিও গ্রাহ্য হয়নি।
প্রক্রিয়াগত পরিমার্জনের পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহারও উন্নততর করে চলছে নির্বাচন পদ্ধতি। 2004 সালে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এস কৃষ্ণমুর্তি দেশ জুড়ে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার চালু করলেন। ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন পরিচালনা এবং পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞত থেকে বলতে পারি পুরনো ব্যালট পদ্ধতিতে ভোটের চেয়ে এটা অনেক বেশি নিশ্চিন্ত ও দ্রুততর পদ্ধতি। অনেক রাজনৈতিক দল যদিও ভিন্ন মত পোষণ করেন। বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোটার তালিকায় নামের সঙ্গে ছবি দিয়ে কম্পিউটারাইজেশনও একটা বড় পদক্ষেপ।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণও ক্রমশই জটিলতর হয়ে উঠেছে। প্রথম যুগের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের তুলনায় এখন প্রতিদিনই প্রতি পর্যবেক্ষককে প্রায় 10 থেকে 12 ঘন্টা বা কখনো তারও বেশি পরিশ্রম করতে হয় নির্বাচনী ক্ষেত্রে পৌঁছনোর পর থেকেই। তাছাড়া নজর রাখার বিষয়ও বেড়েছে। আগে মূলত আইএএস-রা আসতেন, তারপরে যুক্ত হয়েছেন হিসাবে বিশেষজ্ঞ কেন্দ্রীয় আধিকারিকরা, যেমন ইন্ডিয়ান রেভিনিঊ সার্ভিস, ইন্ডিয়ান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট সার্ভিস ইত্যাদি। ইদানীং আইন শৃঙ্খলার অবস্থা বুঝতে আইপিএস-রাও আসছেন। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসের অফিসারদেরও অবজার্ভার হতে নিযুক্ত হতে দেখছি সম্প্রতি। শুরুতে কয়েকটা আদেশনামার মারফতে পর্যবেক্ষণের কাজটা বোঝানো হত। এখন একাধিক খণ্ডের হ্যাণ্ডবুক পড়তে হয়।
নির্বাচনের প্রক্রিয়াটিকে মাইক্রো-ম্যানেজ করার জন্য নিযুক্ত হন বুথ লেভেল অফিসার, মাইক্রো অবজার্ভার ইত্যাদি। পর্যবেক্ষকদের রিটার্নিং অফিসার এবং এলাকার পুরনো ইতিহাসের ভিত্তিতে চিহ্নিত করে নিতে হয় সেই নির্বাচনক্ষেত্রের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলিকে, সরকারি ভাষায় যাকে বলা হয় ভালনারেবিলিটি ম্যাপিং।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাঁধন ক্রমশঃ বজ্র আঁটুনি হয়ে উঠছে, কিন্তু তাতে গণতন্ত্রের গুণমানের ফস্কা গেরোটি সামলানো যাচ্ছে কি না সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অবশ্য কঠিন এই মুহূর্তে।
নির্বাচন কমিশনের বজ্র আঁটুনিতে নাগরিকদের সন্তুষ্টি
2005 সালে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে আমি পর্যবেক্ষক কারাকাট নামে একটি নির্বাচনক্ষেত্র, বিহারের রোহতাস জেলায়। রোহতাস জেলার হেডকোয়ার্টাস শেরশাহের সমাধিস্থল সাসারাম। সেখান থেকে দুপুরে বেরিয়ে পাটনা থেকে কলকাতার ফ্লাইট ধরা সম্ভব ছিল না। রাতটুকু পাটনায় কাটিয়ে পরের দিন ফ্লাইট ধরার প্ল্যান করে পাটনা সার্কিট হাউসে ঢুকেছিলাম বিকেল নাগাদ। খানিক বাদে আমার পুরনো বন্ধু ছাপড়ার জেলা শাসকের ফোন, " সন্ধ্যাবেলায় একা একা পাটনায় বসে কী করবেন? আমার জেলায় শোণপুরে হরিহর ছত্রের প্রাচীন মেলা চলছে, ঘুরে যান।”
গেলাম শোণপুর। জেলা শাসকের অতিথি এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসাবে ভালই খাতির যত্ন জুটলো। শশীশেখর বসুর জবরদস্ত বিবরণের সঙ্গে মেলাতে গিয়ে প্রচুর ঘুরলাম হরিহর ছত্রের মঠে এবং মাঠে।
ভোটের ফলাফলে পাবলিকের একাংশ বেজায় খুশি বোঝা গেল। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে নদীর ধারে একটা বাচ্চা হাতিকে দেখে একটু আদর করার লোভ সামলাতে পারলাম না। হাতির মালিক তাঁবু গেড়ে বসেছিলেন পাশেই। আমার সঙ্গের সেপাই সান্ত্রী দেখে ভক্তি ভরে বেরিয়ে এলেন তাঁবু থেকে। খোকা হাতিটি গায়ে মাথায় হাত বোলানোয় হাতি এবং তার মালিক দুজনেই খুশি। আমার গাড়ির গায়ে ‘নির্বাচন প্রেক্ষক’ এর বোর্ডটি জ্বলজ্বল করছে । হাতির মালিক বললেন, “লে যাইয়ে, স্যার। সির্ফ দেড় লাখমে দে দেঙ্গে।” দেড় লাখ মোটেই ‘সির্ফ’ নয় আমার জন্য। এক ভদ্রলোক পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন আমাদের কথোপকথন। এগিয়ে এসে বললেন, “লে লিজিয়ে, স্যার; আচ্ছা অফার হ্যায়!” নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন বিহার এলিফেন্ট ওনার'স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি তিনি। জিজ্ঞেস করলাম হাতি কত খায়? তাঁর হিসেব সোজা, “ব্যস, সির্ফ চার বিঘা জমিন হোনেসে হো জায়গা ইসকা সাল ভর কি খানা!” আর নিয়ে যাব কী করে? “হমলোক পঁহুছা দেঙ্গে।” অত টাকা তো সঙ্গে নেই, বললাম আমি। “কোই বাত নেই, স্যার। দো পাঁচ শো যো ভি হ্যায়, অ্যাডভান্স দে দিজিয়ে, বাকি ডেলিভারি কে বাদ।” ক্ষণিকের তরে কল্পনা করে পুলকিত হলাম আমার 1200 স্কোয়ার ফিটের ছোট ফ্ল্যাটের তলার গ্যারাজে অন্য সহবাসিন্দাদের পুঁচকে গাড়ি গুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আমার হাতি একটা আস্ত কলাগাছ চিবোচ্ছে; আমি সকাল বিকেল টার্জানের মতো হাতির পিঠে চেপে আই এ মার্কেটে বাজার করছি!
গোল বাঁধল হাতির খোরাকি যোগানোর চার বিঘে জমি নিয়ে। সেটা কোথায় পাব। শেষমেশ নিতে পারব না জেনে ভারি দুঃখিত হলেন বিহার এলফেন্ট ওনারস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মশাই এবং হাতির বিক্রেতা মশাই। প্রেক্ষকের কাজে খুশি হয়ে প্রায় অর্ধেক দাম কমিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁরা হাতিটাকে বিহারের এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষকদের হূঁশিয়ার ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ।। একটু ধন্দেও পড়লেন তাঁরা সম্ভবত, কী রকম আইএএস অফিসার, চার বিঘে জমিও নেই! নির্বাচনী বজ্র আঁটুনিকে সাধারণ নাগরিকদের এই স্বীকৃতি তৃপ্তি দিয়েছিল সেবার।
শেষে আসি গণতন্ত্রের ফস্কা গেরোর কথায়।
লখনৌতে ছিলাম 2007 এর উত্তর প্রদেশ বিধান সভা নির্বাচনের পর্যবেক্ষক হিসেবে। পুরনো লখণৌয়ের একটা পোলিং বুথে বেশ কম ভোট পড়েছে সকালের দিকে। ভোটারদের আটকানো হচ্ছে কিনা খোঁজ নিতে ঘোরাঘুরি করছিলাম ওই পাড়ায়। বেলা সাড়ে নটা দশটা হবে। পুরোনো কিন্তু বেশ পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিহিত এক অভিজাত দর্শন বৃদ্ধ ধীর পায়ে আসছেন রাস্তা দিয়ে। ইনি নিশ্চয় ভোটার হবেন ভেবে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘ভোট নেই ডালেঙ্গে দাদাজি’। দাদাজি দাঁড়ালেন, মন দিয়ে আমার গলায় লটকানো পরিচয় পত্রটি পড়লেন, তারপর মৃদু স্বরে বললেন, ‘ভোট? কোই মাঙ্গে নেহি’। যে বস্তুটি তাঁর কাছে কেউ চায়নি সেটা যেচে কাউকে দেবার কোনও মানে নেই। তিনি নিজের মত চলে গেলেন। তাঁর এই সুভদ্র নির্লিপ্ততায় ভয় পেলাম। সুজনেরা যদি গণতন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ হারান, তাহলে তো মাঠ ফাঁকা থাকবে না, দুর্জনেরা দখল নেবে।
নির্বাচন কমিশনের যাবতীয় বজ্র আঁটুনি কি সাধারণ মানুষের গণতন্ত্রের প্রতি উদাসীনতার ফস্কা গেরো থেকে রক্ষা করতে পারবে আমাদের?
#AzadiKaAmritMahotsav #ElectionCommissionOfIndia #IndianDemocracy