সরকার নিয়ন্ত্রিত কৃষি বাজার এবং খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থা
কৃষিতে দু’টো ইকোসিস্টেম এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিয়ে আলোচনা থেকেই সমস্যাটা বোঝা সম্ভব।
- মূল সমস্যা যে চাষিদের ফসলের ন্যায্য দাম পাইয়ে দেওয়া, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। কিন্তু সরকারের আর একটি দায়িত্ব হল সাধারণ নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী সুলভে অন্ন জোগানোর ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ব্যাপারটা পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে জনতার একটা অংশ না খেয়েই থাকবে। বিশেষ করে যখন খাদ্যশস্যের উৎপাদন জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। তাই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু 1955 সালে সংসদে ‘এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট’ পাশ করান। সেই আইন বলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি খাদ্যশস্য মজুত করা আইনত অপরাধ। পাশাপাশি নেহরু আনলেন পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (পিডিএস) বা রেশন ব্যবস্থা, যাতে গরিব মানুষ কম দামে অন্তত মোটা চাল-গম খেয়েও বাঁচতে পারে। এই আইনটিই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে বাতিল করেছেন। তাই আশঙ্কা, গণবণ্টন ব্যবস্থা থেকেও সরকার হাত তুলে নেবে না তো? এখন ভারত খাদ্যশস্য রফতানি করা দেশ। আমাদের দেশে চাল-গম প্রয়োজনের তুলনায় উদ্বৃত্ত। সরকারের গুদামে বাড়তি খাদ্যশস্য পচে যায়। তবু কিছু লোক অনাহারে মারা যায়। কারণ আয়বৈষম্য ও বিতরণ ব্যবস্থায় অসাম্য।
- ষাটের দশকের শেষে চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে দু’টো যুদ্ধ সামলে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ে মা-ভবানী। কিন্তু পরপর দু’টো অনাবৃষ্টি এবং দুর্ভিক্ষে রেশনে দেওয়ার মত চাল-গমেও টান পড়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং ইন্দিরা গান্ধীর উদ্যোগে কৃষি অর্থনীতিবিদ স্বামীনাথন নিয়ে এলেন মার্কিন বিশেষজ্ঞ নরম্যান বোরলাগকে। এল মেক্সিকো থেকে উচ্চ-ফলনশীল হাইব্রিড বীজ। শুরু হল কেমিক্যাল সার ও কীটনাশকের ব্যবহার সমৃদ্ধ ‘সবুজ বিপ্লব’। এর অনেক দুর্গুণ আছে, যেমন গ্রামাঞ্চলে আর্থিক অসাম্য ও জমির কেন্দ্রীকরণ বাড়িয়ে দেওয়া এবং জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট করা।
- কিন্তু এর সুফল হল এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে ভারত খাদ্যশস্যের ব্যাপারে আমদানি-নির্ভর, হাত পেতে থাকা দেশের বদলে খাদ্যে আত্মনির্ভর রফতানি-কারক দেশ হয়ে গেল। এখন সমস্যা হল উদ্বৃত্ত ফসলের, ফলে দাম পড়ে গেলে কৃষকের কী হবে? আবার দাম বাড়ালে শহুরে অ-কৃষক জনতা রেগে যাবে। সরকারের হল শাঁখের করাত।
- গত শতাব্দীর শেষে সরকার ওই সমস্যার মোকাবিলা করেছে তিন ভাবে।
- ইনপুট কস্ট বা উৎপাদন ব্যয় কম করতে সরকার কৃষককে ভর্তুকি দিয়েছে বীজ ও কেমিক্যাল সারে, বিদ্যুৎ বিলে এবং সেচ করে। পুঁজির ব্যাপারে ব্যাঙ্ক ঋণে সুদের হারেও ভর্তুকি দিয়েছে।
- কৃষককে ফসলের ন্যায্য দাম পাইয়ে দিতে এগ্রিকালচারাল প্রোডাকশন অ্যান্ড মার্কেটিং কর্পোরেশন (এপিএমসি) গঠন করে সরকারি মান্ডি শুরু করেছে। যেখানে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্রেতা নিলাম করে ফসলের দর ঠিক করবে। কৃষক হয় ওই দামে বিক্রি করবে, নয় সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে (যা বাজার দরের চেয়ে সামান্য বেশি) কিনে নেবে। আর সরকার এর থেকেই রেশন দোকানে চাল-গম দেবে।
- ইউপিএ-2র অন্তিম দিনগুলোতে মনমোহন সিং সরকার পাস করায় ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা খাদ্য সুরক্ষা আইন। অর্থাৎ, সরকারের দায়িত্ব হল পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য সরকারি ব্যবস্থায় মজুত করে সুনিশ্চিত করা, যাতে কেউ না খেয়ে মরবে না। এর প্রয়োগে এল গণবণ্টন ব্যবস্থা মজবুত করে নাগরিকদের দু’টো ভাগে – দারিদ্রসীমার নীচে (বিপিএল) ও ওপরে (এপিএল)— ভাগ করে গম 2 টাকা এবং চাল 3 টাকা ও 10 টাকা কিলো দরে বিতরণ করা।
- সুপ্রিম কোর্ট তখন একধাপ এগিয়ে বলল, যে কোনও জেলায় কেউ অনাহারে মারা গেলে তার জন্য জেলার কালেক্টর দায়ী হবেন। এও বলল যে, সরকারি গুদামে উদ্বৃত্ত অন্ন পচতে না দিয়ে নিরন্নদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা উচিত।
- এর থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, এমএসপি শুধু কৃষকের জন্যে পয়মন্ত না, সরকারের জন্যেও। নইলে খোলা বাজারে সরকারকে বেশি দামে চাল কিনে রেশন ব্যবস্থা চালাতে হবে।
আরও পড়ুন: রাজপথে কৃষক 1: পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দু’টো আলাদা ইকোসিস্টেমের লড়াই
কিন্তু এর মধ্যে গলদটা কোথায়?
আছে, ফাঁক ফাঁকি দুইই আছে, ভালর সংখ্যা সাতান্ন হলেও মন্দ তিন-চল্লিশ হবেই—রবি ঠাকুর বলে গেছেন।
- গোটা দেশে মান্ডি বা সরকারি এপিএমসি বাজার মাত্র 7,400; তার মধ্যে 4,000 হল পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতে।
- পাঞ্জাব, হরিয়ানা বাদ দিলে অধিকাংশ রাজ্যেই মান্ডি অনেক দূরে দূরে; সেখানে পৌঁছনোর রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অবহেলিত। তাই নিরুপায় গরিব চাষি তার অল্প উৎপাদন স্থানীয় ফড়ের কাছেই বেচে।
- রেজিস্টার্ড ক্রেতা ও আড়তদারের কমিশনের ফলে চাষি প্রাপ্যের চেয়ে কম দাম পায় ।
- ওই বিক্রেতারা সম্পন্ন এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত। ওরা নিজেদের মধ্যে সাঁট করে (কার্টেল বানিয়ে) ক্রয়মূল্য চড়তে দেয় না।
- সরকারি গোডাউন এবং স্টোরেজ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। কাজেই চাষিরা চাইলেও সরকারের কাছে সবটা বিক্রি করতে পারে না। এছাড়া এফসিআইয়ের দুর্নীতিও কৃষককে ন্যায্য দাম পাইয়ে দেওয়ার পথে একটা বাধা।
- এমএসপি’র তালিকায় 21টি নাম থাকলেও সরকার কেনে শুধু ধান ও গম, কখনও কখনও সামান্য ডাল। ফলে শাকসব্জি ফলফুলের চাষ করতে গিয়ে চাষি বাজারের ওঠানামায় ধোঁকা খায়। এক বছর পেঁয়াজ ও আলুর দাম চড়ল তো চাষি পরের বছর ধার করে আলু বুনল বিশাল লাভের আশায়। সবাই তাই করায় অতি-উৎপাদনের ফলে দাম ঝপ করে পড়ে গেল। নিরুপায় চাষি আত্মহত্যা করল।
অবশ্য 2016 সাল থেকে বর্তমান সরকার কৃষকদেরর আত্মহত্যার তথ্য প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কাজেই পুরনো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে যত বেচাকেনা, আর চলবে না। কৃষি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার চাই।
দ্বিতীয় ইকোসিস্টেম বা ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও’
বর্তমান সরকার তিনটি কৃষি সংশোধনী আইনের মাধ্যমে যে বিকল্প ব্যবস্থাকে ‘ঐতিহাসিক’ পদক্ষেপ বলে বুক বাজাচ্ছে তার মূল স্বরূপ হল কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে ঠিক শিল্পের মতো খোলা বাজার তৈরি করা। কেন?
- ভারতের প্রায় 50% জনসংখ্যা আজও কৃষিতে নিযুক্ত। অথচ জিডিপিতে তার যোগদান 17% এর বেশি নয়। এদের মধ্যে 80% হল ছোট ও প্রান্তিক চাষি; এবং চাষের জমির উপর জনসংখ্যার ভার অনেক বেশি। অনেক কৃষকই সারা বছর পুরো কাজ পায় না। এর জন্যে কৃষকদের মধ্যে অন্তত অর্ধেক লোকজনের উচিত কৃষি ছেড়ে কারিগরি, শিল্প বা শহরে অন্য জীবিকা খুঁজে নেয়া। তা হলে পরিবারে কৃষিতে নিযুক্ত লোকের সংখ্যা কমে মাথাপিছু আয় বেড়ে যাবে।
- এছাড়া দরকার উৎপন্ন ফসলের ন্যায্য দাম পাইয়ে দেওয়া, যা সরকার নয় মুক্ত বাজার ঠিক করবে। কী ভাবে?
- কেবল সরকারি মান্ডিতে ফসল বেচার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে গোটা দেশে যেখানে ভাল দাম পাবে সেখানেই বেচতে পারবে। ফলে আয় বৃদ্ধি হবে।
- কেমিক্যাল সার, কীটনাশকের সাহায্যে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধান-গমের চাষে খরচ প্রচুর, লাভের মার্জিন কম। তাই দরকার হল ধান-গমে আটকে না থেকে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপন্ন করা (ডাইভারসিফিকেশন)। কিন্তু চাষিরা ভয় পায় ফল-ফুল-শাক-সব্জির বাজারের ওঠানামায়। এর সমাধান হিসেবে মোদী সরকার এনেছেন ‘কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং’। তাতে গাঁয়ের ছোট কৃষকেরা উপকৃত হবে। বড় পুঁজিপতি খবর রাখে শুধু দেশের বাজারের নয়, বিশ্ববাজারেরও। সে দেখবে কোন বিশেষ ফসল বা ক্যাশ ক্রপে বাঁধা বাজার আছে এবং লাভের অঙ্ক ভাল। একজন পুঁজিপতির সঙ্গে চুক্তি করবে গোটা গাঁয়ের ছোট-বড় সব চাষি। দাম আগাম ঠিক করা হবে। কোন ফসল বোনা হবে তা ঠিক করবে চাষি নয়, পুঁজিপতি। চাষির কাজ খালি চাষ করা। বাজারের চিন্তা ওকে করতে হবে না।
- এর জন্যে চাই কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ। সরকারের বিনিয়োগ হল 2020-21 এর বাজেটের 5%, এবং জিডিপি’র 1% এরও কম। সরকার কত করবে? তাই চাই বেসরকারি বিনিয়োগ, দেশি-বিদেশি সব চলবে।
- ফসল ভান্ডার ইত্যাদিতে বেসরকারি বিনিয়োগ আনতে হলে কৃষিতে সরকারি হস্তক্ষেপ কমিয়ে বাজারনির্ভর এবং লাভজনক করতে হবে। স্থানীয় নয়, দেশজোড়া বড় বিনিয়োগ চাই। কর্পোরেট পুঁজি এসে বিশাল সব স্টোর বানাবে। মিডলম্যানদের বাদ দেবে। বিশ্ববাজারে কৃষিজাত পণ্য রফতানি হবে। তাই মজুতের ওপর কোনও নিষেধ, কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণ চলবে না।
- এই নতুন ইকো-সিস্টেমে কোনও মিডলম্যান, আড়তদার বা ফড়ে থাকবে না। এতে কৃষক হবে বেচারাম, বড় পুঁজি হবে কেনারাম। এভাবে ফসল, বড় ক্রেতা ও অ-কৃষক শহুরে গ্রাহকের মধ্যেও সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হবে। আদানির অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় বিশাল ‘সিলো’ গুদাম এবং রিলায়েন্স বা আমাজন রিটেলস চেনে তারই পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
- গোটা দেশে একটাই বাজার হবে সেটা মোদী সরকারের e-NAM যোজনার মাধ্যমে ইন্টারনেট দিয়ে যুক্ত হবে। তাতে বাংলার চাষি ইন্টারনেট দেখে কেরালায় যদি ভাল দাম পায় তো সেখানে চাল পাঠানো বুক করে নেবে। ক্রেতা তার এজেন্ট দিয়ে চাষির দোরগোড়া থেকে ফসল তুলে নেবে। চাষির অ্যাকাউন্টে অনলাইনে পেমেন্ট এসে যাবে। যেন ঘরে বসে অ্যামাজন বা ওএলএক্সে কেনাবেচা!
- সমস্যা হল 14 এপ্রিল 2016 তে প্রধানমন্ত্রী এই ই-নাম যোজনার উদ্ঘাটন করেছিলেন। এখন সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী মেরেকেটে 1,000 মান্ডি যুক্ত হয়েছে। মাত্র 15%। প্রশ্ন 100% লক্ষ্য হলেও দেশের 5 কোটি কৃষক অনলাইনে ধান, গম, ফল, শাকসব্জি কেনাবেচা করবে? নেটওয়ার্ক? অবশ্য আগামী বছরে গোটা দেশে 5-জি নেটওয়ার্ক কে আনছেন আমরা সবাই জানি।
আরও পড়ুন: রাজপথে কৃষক 2: গোষ্ঠী-চেতনা দিয়েই যেতে হবে সমস্যার মূলে
বেশ, তবে এর মধ্যেই বা দোষটা কোথায়?
- এই মডেলের পেছনে ধারণাটি হচ্ছে ক্রেতা কর্পোরেট হাউস এবং বিক্রেতা চাষিরা সমান সমান। যেন বার্সেলোনা ও রিয়েল মাদ্রিদের ম্যাচ! তাই দু’পক্ষকে সমান স্বাধীনতা দিলে সবার ভাল হবে। কিন্তু বেসিক ধারণাটিই ভুল। সারা দেশ জুড়ে আম্বানী-আদানিদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি অত্যাধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গোডাউনের জালের সঙ্গে অবাধ মজুতের আইনি অধিকার যুক্ত হয়ে এমন বিশাল শক্তি তৈরি হবে, যার সঙ্গে চাষিদের এঁটে ওঠার প্রশ্নই নেই। কারণ কৃষকদের 80% হল ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি।
- ওরা ভাল দামের আশায় ফসলকে গুদামে ধরে রাখতে পারে না। ওদের নতুন ফসল ওঠামাত্র কম দামে ছেড়ে দিতে হয় ধার শোধ করতে এবং ঘরের খরচা চালাতে। কিন্তু কর্পোরেট এক বছর ফসল গোডাউনে ধরে রেখে পরের বছর প্রথমে কেনার গরজ না দেখিয়ে চাপ দিয়ে দর কমাতে বাধ্য করতে পারে। অর্থাৎ, শক্তিমান ও দুর্বলের সমান স্বাধীনতা বাস্তবে শক্তিমানের স্বাধীনতা।
- তাই কৃষকদের মান্ডি ব্যবস্থায় ‘খাঁচার পাখি’ আর নতুন আইনে ‘মুক্ত বিহঙ্গ’ বলার কোনও মানে নেই। নীল আকাশে বাজপাখি ও টিয়া একসঙ্গে উড়লে কী হবে সবাই বোঝে। সেই রিস্ক নেওয়ার চাইতে খাঁচার সুরক্ষা ছোট চাষিদের জন্যে বেশি দরকারি। চাষির স্বাধীনতা রয়েছে যে কোনও বাজারে ফসল বেচার- সরকারি মান্ডি বা বাইরে বেসরকারি মান্ডি— কথাটা সত্যি নয়। পরিস্থিতি ও ইকোসিস্টেম ঠিক করে সে কোথায় যাবে।
- আপনি ছাপোষা মানুষ। সামান্য সঞ্চয় কোথায় রাখবেন কম সুদে সরকারি ব্যাঙ্কে? নাকি বেশি লাভ করে বড়লোক হওয়ার আশায় শেয়ার বাজারে? একদিকে আপনার অবস্থা বদলাবে না কিন্তু খারাপও হবে না, আপনি সেফ। অন্যদিকে রাতারাতি রাজা হতে পারেন বা ফকির। দেখুন, এই ফাটকায় বড়ভাই মুকেশ রাজা হয়েছে, ছোটভাই অনিল ফকির।
- চাষিরা আপনার আমার মতোই ভাবছে—চাই না মাগো রাজা হতে! কিন্তু আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।
- কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং হলে চাষি নিজের ইচ্ছেমতো ফসল বোনার স্বাধীনতা হারাবে। কর্পোরেট লাভের জন্যে বা নিজের শিল্পের কাঁচামালের জন্যে যে চাষ করতে হবে তাই ওকে করতে হবে। এইভাবে ক্যাশ ক্রপ বেড়ে এবং খাদ্যশস্যের চাষ কমে ‘খাদ্য সুরক্ষা’ মার খেতে পারে।
- এইখানেই দরকার সরকারের হস্তক্ষেপের। সরকারকে খেলতে হবে না, আম্পায়ারিং করলেই হবে। কিন্তু সরকার সেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।
- কৃষি এবং শিল্পকে এক আসনে বসিয়ে দেখলে ভুল হবে। শিল্পপতির প্রেরণা হল মুনাফা এবং পুঁজি বৃদ্ধি। কৃষকের জমির সঙ্গে রয়েছে এক পুরুষানুক্রমিক আত্মীয়তা বোধ। চাষ করাকে কেন্দ্র করে কত গান, উৎসব লোকাচার গড়ে উঠেছে। ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে?
- এই গোষ্ঠী চেতনা থেকে রবীন্দ্রনাথ লেখেন “দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে, এমনি লক্ষ্মীছাড়া!” বাম সরকার এই আবেগকে বোঝেনি বলেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হয়েছে।
- কৃষক পরিবার থেকে অর্ধেক লোক শহরে গিয়ে ভিড় করবে? শিল্পে? পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে? এই প্রেসক্রিপশন সবচেয়ে মারাত্মক। এটি 200 বছর আগের ইউরোপীয় মডেল থেকে ধার করা। আজকের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে তার যোগ কোথায়?
- শহরে কাজ কোথায়? করোনা আসার আগে থেকেই গত 45 বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারি 6.5%। শিল্পে মন্দা। মনমোহন সরকারের মুক্তবাজারের শিল্পনীতিতে হয়েছে রোজগারবিহীন বিকাশ বা ‘জবলেস গ্রোথ’। এখন তো ফ্যাশন হল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগে আরও শ্রমিক কমানো। উন্নত প্রযুক্তি মানেই মেশিন বেশি, শ্রমিক কম।
- শিল্পে বিক্রেতা নিজের পণ্যের দাম বলে দরাদরি শুরু করে। সার্ভিস সেক্টরের পণ্য অর্থাৎ বিমা, শিক্ষা, ডাক্তার , উকিল –সবার জন্যেই এটি সত্যি।
- কিন্তু কৃষিপণ্য বা ফসলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। ফসলের দাম ঠিক করে উৎপাদক কৃষক নয়, ক্রেতা ফড়ে।
- তাই ফসল বিক্রির খোলা বাজারে কৃষকের স্বাধীনতা সীমিত। কারণ 80% হল ছোট ও প্রান্তিক গরিব চাষি। ওরা কর্পোরেটের প্রতিনিধির সঙ্গে কী করে দরাদরি করবে? ওদের নগদ টাকা চাই। ডিজিটাল পেমেন্ট বা একমাস পরে টাকা পেলে ওদের চলবে না।
- অর্থনীতিবিদ রামকুমার এবং দেবিন্দর শর্মা বলছেন এই মডেলটি আকাশ থেকে পড়া ইউনিক মডেল নয়। কৃষির ক্ষেত্রে এই মডেলটি ইউরোপ-আমেরিকায় ব্যর্থ। এতে কোথাও চাষিদের আয় দ্বিগুণ হয়নি। উল্টে এটা আজ প্রমাণিত যে কৃষিকাজ আর লাভজনক নয়। কিন্তু খাদ্য সুরক্ষার স্বার্থে একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ভর্তুকি দিয়ে। নব্য-উদারবাদী অর্থনীতিবিদরা চেপে যাচ্ছেন যে আমেরিকাতে চাষিদের আয়ের 40% আসে সরকারি ভর্তুকি থেকে। ইউরোপ জাপান সর্বত্র একই চিত্র। তাহলে ভারতে কেন আমরা এমএসপি বন্ধ করার কথা ভাবব?
- মুখ খুলেছেন মোদী-মন্ত্রিসভা থেকে কয়েক মাস আগে ইস্তফা দেওয়া হরসিমরন কৌর। বলছেন আম্বানীর জিও যেমন আগে মিনি মাগনায় মোবাইল ধরিয়ে সব প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দিয়ে শেষে সমানে দাম বাড়াচ্ছে, নতুন আইনে স্বাধীনতা পাওয়া কর্পোরেট হাউস ঠিক ওইভাবে প্রথমে চাষিদের লোভ দেখিয়ে মান্ডির বাইরে আনবে, তারপর একচেটিয়া অধিকার জমিয়ে ওদের লুটে নেবে।
(ক্রমশ)