আজকাল সবারই কথায় কথায় গায়ে ছ্যাঁকা লাগে। আপনার কোন কথায় বা কোন জোক যে কার ধর্মানুভূতিতে আঘাত করবে! ব্যাপারটা খানিকটা জ্বর আসার মতো। জ্বর কখন আসবে তা আপনিও জানেন না, সেও জানে না।
[‘জ্বরব্যাধি’- ইনিও বৈদিক দেবতা, এঁর স্তোত্র দেখুন অথর্ব বেদের পঞ্চম খন্ডে 22 নম্বর স্তোত্র; ‘হে জ্বরব্যাধি, আমার প্রতি প্রসন্ন হও, আমাকে তপ্ত এবং রক্তবর্ণ করে তুলো না’।]
এসবের ঝামেলায় আমাদের খাদ্যভ্যাস নিয়ে সরকারের নাক গলানো শুরু হল। যাতে কারও ধর্মীয় আবেগে আঘাত না লাগে। আগে গোমাংস নিষিদ্ধ হল। সন্দেহের বশে উত্তরপ্রদেশের দাদরি গাঁয়ে গণপিটুনিতে এয়ারফোর্সের কর্মচারী পুত্রের বাবা আখলাকের প্রাণ গেল। এরপর বিভিন্ন রাজ্যে আরও কয়েকজন, সন্দেহ হলেই হল। প্রমাণের দরকার নেই। আজ অবধি কারও শাস্তি হয়নি। গত 14 জানুয়ারি 2021 তারিখে সাউথ দিল্লি মিউনিসিপাল কর্পোরেশন (SDMC) নতুন ফরমান জারি করেছে যে, সমস্ত নন-ভেজ রেস্তোরাঁকে নোটিস বোর্ডে লিখতে হবে, ওদের রান্না মাংসগুলো কীভাবে এসেছে, ‘হালাল’ (মুসলিম মতে গলায় আড়াই পোঁচ দিয়ে জবাই করা), নাকি ‘ঝটকা’ (এক ঝটকায় গর্দান আলাদা করে দেওয়া)? কারণ ক্রেতার অধিকার আছে এটা জানার যে, ওরা কেমন মাংস খাচ্ছে। হিন্দু ও শিখের নাকি হালাল ধর্মবিরুদ্ধ, এবং মুসলমানের ঝটকা। কাজেই এই ব্যাপারে গাফিলতি হলে জেল হতে পারে। [1] রেস্তোরাঁ মালিকরা বলছেন, মহা মুশকিল। কোনও গ্রাহক জানতে চায়নি খাবারের মাংস ঝটকা নাকি হালাল? ওরা স্বাদ হিসেবে পছন্দ বা অপছন্দ করে। এটা জানাও কঠিন যে স্লটার হাউস (কসাইখানা) থেকে আনা মাংস হালাল না ঝটকা? তবে দিল্লির অধিকাংশ কসাই হল মুসলমান।
ইদানীং শুনছি বঙ্গে পোস্টার পড়ছে— মৎস আমাদের অবতার। কাজেই মাছ খাওয়া ছাড়তে হবে, নইলে গণপিটুনি। [2]
কী মুশকিল! কুর্ম এবং বরাহও তো অবতার, একই লাইনে; মানে জয়দেবের দশাবতার স্তোত্রে। তাহলে ও দু’টো খাওয়াও ছাড়তে হবে নাকি? এসবই নাকি শাস্ত্রে মানা রয়েছে। কোন শাস্ত্রে? বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত কোথাও গরুকে মাতা বলতে দেখলাম না। তাই মনুস্মৃতিতেই খোঁজ করা যাক। কারণ, আগেই বলা হয়েছে— যা আছে তা মনুস্মৃতিতেই আছে, এবং যা এতে নেই তা কোথাও নেই। আর হালাল বা ঝটকা? এও কি মনুস্মৃতিতে বলা আছে? একটু নেড়ে চেড়ে দেখি।
দ্বিজের কী কী খেতে নেই
বেশ লম্বা লিস্টি।
• ধরুন পেঁয়াজ, রসুন, গাজর, ব্যাঙের ছাতা, চালতে, গাছ কাটা রস, বাছুরের জন্ম হলে প্রথম দশদিনের যে গাঢ় দুধ (পীযূষ), উটের এবং ভেড়ার দুধ, মোষ ছাড়া সব বুনো জন্তুর দুধ, মৃত বৎসা গাভীর দুধ, স্ত্রীলোকের দুধ- এসব বর্জনীয় (5/5,6,8,9)।
• সাপ, অজানা পশুপাখি বা বানরের মতো পাঁট নখওয়ালা জন্তুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ (5/17)।
• পাখির মাংস খাব যে, সে গুড়ে বালি! সমস্ত মাংসাশী পক্ষী, গ্রামবাসী পক্ষী, একখুর পশু ও তিতির পাখি, চড়ুই, হংস, চক্রবাক, গ্রাম্যকুক্কুট বা দেশি মুরগি, সারস, ডাহুক, টিয়া ও শালিখ, বক, দাঁড়কাক, খঞ্জন, কুমীর এবং সবরকমের মাছ বর্জনীয় (5/11, 12, 14।
মরেছে! মাশরুম, চিকেন এবং সবরকম মাছ নিষিদ্ধ! বাঙালি খাবেটা কী? সব মাছ নাকি মাংসভোজী, কাজেই বর্জনীয় (5/15)।
ঘাবড়াবেন না। মনু মহারাজ আমাদের কথা ভেবেই ব্যাকডোর এন্ট্রির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
কী কী খাওয়া যায়
• দেবকার্যে (পুজোয়) এবং পিতৃকার্যে (শ্রাদ্ধাদি) নিবেদিত বোয়াল, রুইমাছ, সিঙ্গি মাছ ও সমস্ত আঁশযুক্ত মাছ খাবে।
• দেবতাকে ভোগ না দিয়ে তিল সহ সেদ্ধ ভাত, ঘি, অসংস্কৃত (মন্ত্র পড়ে শুদ্ধ না করা) পশুমাংস খাওয়া যাবে না (5/7)। আসল কথা হল ওই ঠাকুরকে নিবেদন করে খাওয়া। আগে নিবেদন করুন, তারপর খেয়ে নিলে অসুখ করবে না।
সত্যজিৎ খামোখাই ‘গণশত্রু’ ফিলিম বানিয়েছিলেন।
• পাঁচ নখওয়ালা জন্তুদের মধ্যে সজারু, গোসাপ, খরগোশ, কচ্ছপ এবং গন্ডারের মাংস খাওয়া যাবে এবং উট ছাড়া অন্য একপাটি দাঁতওয়ালা জন্তুর মাংস খেতে বাধা নেই (5/1)।
• প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের যজ্ঞে পশু-পক্ষীর মাংস দিয়ে ‘পুরোডাশ’ (মাংসের পুর দেওয়া পিঠে জাতীয় যা যজ্ঞে হবি হিসেবে প্রদান করা হয়) প্রস্তুত হয়েছিল এবং মনুর বিধান হল যজ্ঞের ও বৃদ্ধ মাতা পিতার জীবনধারণের প্রয়োজনে ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক পশুপাখি বধ করা নিষিদ্ধ নয়; অগস্ত্য মুনি নাকি তাই করেছিলেন (5/22,23)।
মাংস খাওয়ার বিধিসমূহ
মনে হয় মনু শেষ অবধি এ’নিয়ে দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অথবা নিয়মগুলো সময়ের সঙ্গে অনেকবার বদলে গেছে। মাংস খাওয়ার পক্ষে যুক্তিগুলো দেখুন-
o প্রতিদিন যাদের খাওয়া যায় সেইসব প্রাণীদের ভক্ষণ করলে দোষ হয় না। বিধাতাই খাদ্য ও খাদক উভয়কেই সৃষ্টি করেছেন (5/30)।
o হরিণ নরম দাঁতে খায় নরম ঘাস, হিংস্র দাঁতওয়ালা বাঘ খায় হরিণ, মানুষের আছে হাত, ওরা খায় তাদের, যাদের হাত নেই মানে মাছ। সিংহের মতো বীরের খাদ্য ভীতু হাতি (5/29)।
o যজ্ঞে মন্ত্রপুত মাংস ব্রাহ্মণের অনুমতি নিয়ে খাওয়া যায়। শ্রাদ্ধে, মধুপর্কে অথবা খাদ্যাভাবে প্রাণ সংশয়ে মাংস খাওয়া যায়।
o যজ্ঞের জন্য মাংস খাওয়া দৈব বিধি; যজ্ঞ ছাড়া মাংস খাওয়া রাক্ষসবিধি (5/31)।
o মাংস কিনে বা পশুপালন করে বা অন্যের থেকে উপহার পাওয়া মাংস পিতৃগণকে অর্চনা করে খেলে দোষ হয় না (5/32)।
o শ্রাদ্ধে বা মধুপর্কে যথাবিধি নিযুক্ত হয়ে যে মাংস খায় না, সে মরে গিয়ে একুশ জন্ম পশুত্ব প্রাপ্ত হয় (5/35)।
এ তো একেবারে গলায় গামছা দিয়ে মাংস খাওয়ানো!
এবার শুনুন উলটো যুক্তি
o প্রাণী হিংসা না করে কখনও মাংস উৎপন্ন হয় না। প্রাণীবধ স্বর্গলাভের সহায়ক নয়, সুতরাং মাংস বর্জন করবে (5/48)।
o রক্ত এবং শুক্রের থেকে মাংসের উৎপত্তি। একে ঘৃণাজনক বিবেচনা করে এবং প্রাণীবধ নিষ্ঠুর কর্ম জেনে সকল প্রকার মাংস ভক্ষণ বর্জন করবে (5/49)।
o যে নিজের সুখের ইচ্ছায় অহিংস প্রাণীকে হত্যা করে, সে জীবনে মরণে কোথাও সুখ পায় না (5/45)।
o ইহলোকে যার মাংস খাচ্ছি, পরলোকে সে আমাকে খাবে— মনীষীগণ ‘মাংস’ শব্দের এই অর্থ করেছেন (5/55)।
যেন ঘড়ির পেন্ডূলাম-- এদিক থেকে ওদি্ক, বাম থেকে দক্ষিণ--হার্মনিক মোশনে দুলছে। কিং কর্তব্যম?
• মাংসভক্ষণে, মদ্যপানে ও মৈথুনে দোষ নেই; এই হল জীবের প্রবৃত্তি। নিবৃত্তি মহাফলজনক (5/56)। যেন আপনার পারিবারিক ডাক্তার বলছেন– মাছ, মাংস, মিষ্টি, ওয়াইন সবই খাবেন, কিন্তু হিসেব করে। সর্বম অত্যন্ত গর্হিতম। বাড়াবাড়ি ভাল নয়, রয়ে সয়ে।
এই হল খাঁটি কথা। প্রথম জীবনে প্রবৃত্তির কথা শুনে চলব। বৃদ্ধ হলে মহাফল লাভের আশায় নিবৃত্তির হাত ধরব।
দণ্ডবিধি ও পদ্ধতি নিয়ে দু’চারটে কথা
স্কুলে আমার বাংলার মাস্টারমশাই ক্লাসে একটা লিকলিকে বেত এনে দোলাতে দোলাতে শোনাতেন-
‘বেত্রবিদ্যা বেত্রপাঠ বেত্র চমৎকার,
ইহার দেখিবে সবে মহিমা অপার।’
সে মহিমা আমরা যথাসময়ে টের পেতাম।
দেখা যাচ্ছে মহর্ষি মনু ও আমার সেই মাস্টারমশাই একই গোত্রের। ইনিও দণ্ডের মহিমায় বিশ্বাসী। রাজার শাসনের মূল নীতি হিসেবে ওই চারটে মানে সাম- দান- দণ্ড- ভেদের [3] কথা বললেও তাঁর বিশেষ ভরসা ছিল ডান্ডা চালানোয়।
সপ্তম অধ্যায়ের গোড়াতেই আছে রাজশাসনে দণ্ডের মহিমা।
• দণ্ড সকল লোককে শাসন করে, দণ্ডই রক্ষা করে। লোক নিদ্রিত থাকলে দণ্ড জাগ্রত থাকে; পণ্ডিতগণ দণ্ডকে ধর্ম বলেছেন (7/18)।
• বিবেচনাপূর্বক প্রযুক্ত দণ্ড সকল প্রজার মনোরঞ্জন করে। কিন্তু অবিবেচনাপূর্বক প্রযুক্ত হলে সব দিক নষ্ট করে (7/19)।
• বিষয়াভিলাষী, ক্রোধপরায়ণ, ছলান্বেষী রাজা দণ্ড দ্বারাই নিহত হন (7/27)।
• পৃথিবীতে সকল লোক দণ্ডের বশীভূত। শুচি লোক সত্যি দুর্লভ। দণ্ডের ভয়েই লোকে সমগ্র জগৎ ভোগ করতে সমর্থ হয় (7/22)।
রাজাদের জন্য আরও বলা আছে
• রাজা বকের ন্যায় বিষয়সমূহের চিন্তা করবেন, সিংহের ন্যায় পরাক্রম করবেন, নেকড়ে বাঘের মতো অপহরণ করবেন এবং বিপরীত পরিস্থিতিতে খরগোশের মতো পালিয়ে যাবেন (7/106)।
• ক্ষাত্রধর্ম বোঝাতে গিয়ে মনু বলছেন- রাজা কখনও নিদ্রিত, বর্মহীন, উলঙ্গ, নিরস্ত্র, যে শুধু দর্শক, যুদ্ধ করছে না এবং অপরের সঙ্গে যুদ্ধরত ব্যক্তিকে হত্যা করবেন না (7/92)।
এই জায়গাটায় থমকে দাঁড়াতে হল। নিরস্ত্র বা অপরের সঙ্গে যুদ্ধরত? নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইন্দ্রজিৎ নিরস্ত্র ছিলেন, কিন্তু লক্ষণ তাঁকে ওই অবস্থায় হত্যা করলেন। বালী ও সুগ্রীব দু’ভাই মল্লযুদ্ধ করছিলেন। রাম গাছের আড়াল থেকে বালীকে তিরে বিঁধে বধ করলেন।
এঁরা কি ক্ষাত্রধর্ম জানতেন না? নাকি মনুস্মৃতি ভুল? মৃত্যুর আগে ইন্দ্রজিৎ এবং বালী এঁদের বিরুদ্ধে ক্ষাত্রধর্মের বিপরীত আচরণের অভিযোগই এনেছিলেন।
দণ্ডনীতির কিছু উদাহরণ: নারীদের দণ্ড
মনু বলছেন- স্ত্রীলোকের মুখ সর্বদা শুদ্ধ (5/130)।
যাক, এতক্ষণে মেয়েদের সম্বন্ধে একটা ভাল কথা শোনা গেল, নইলে হাঁফ ধরে গিয়েছিল!
মুজতবা আলি সাহেব ‘দেশে বিদেশে’-তে লিখেছেন, আফগানিস্তানের কোনও বিবাহ সভায় স্বর্গীয় এক গান শোনার স্মৃতি; ‘সবি আগর, সবি আগর’। যদি একবার, শুধু একবার প্রিয়ার মুখচুম্বন করতে পেতাম, তাহলে ‘জোয়ান বলম’, আবার নওজোয়ান হতাম।
তবে স্ত্রীসম্ভোগ করলে পুরুষকে স্নান করতে হবে (5/144)। কী গেরো!
কিন্তু বেদবিরোধী পাষন্ডধর্মাবলম্বী, স্বৈরিণী, গর্ভপাতকারিণী, পতিঘাতিনী, মদ্যপায়িনী নারীদের পারলৌকিক ক্রিয়া নিষিদ্ধ, মানে তাদের আত্মার সদগতির জন্যে শ্রাদ্ধশান্তি ইত্যাদি করা যাবে না! (5/90)
কন্যা উচ্চতর বর্ণের পুরুষকে সম্ভোগার্থে ভজনা করলে দন্ডিত হবেনা, কিন্তু নিম্নবর্ণের লোককে ভজনা করলে তাকে ঘরে আটকে রাখতে হবে। (৮/৩৬৫)।
কোনও পুরুষ যদি স্বজাতির কোনও কন্যার যোনিতে দর্পভরে অঙ্গুলি প্রক্ষেপ করে, তবে তার দু’টো আঙুল কেটে ফেলা হবে এবং 600 পণ দণ্ড দিতে হবে (8/367)।
কিন্তু মেয়েটি ইচ্ছুক হলে আঙুল কাটা যাবে না, শুধু 200 পণ দন্ড হবে (8/368)।
কিন্তু কন্যাই যদি অন্য কন্যাকে অঙ্গুলি প্রক্ষেপে দূষিত করে, তবে তার 200 পণ দন্ড হবে, 400 পণ বাবাকে দেবে এবং দশ ঘা’ বেত খাবে (8/369)।
কোনও স্ত্রীলোক যদি কন্যাকে অঙ্গুলি প্রক্ষেপ দ্বারা দূষিত করে, তবে তার দুই আঙুল কেটে, মাথা মুড়িয়ে গাধায় চড়িয়ে ঘোরানো হবে (8/370)।
ব্যভিচারিণী স্ত্রীকে স্বামী একটি ঘরে বন্ধ করে রাখবেন এবং পরদার গমনে পুরুষের যা প্রায়শ্চিত্ত, তা তাকে করাবেন (11/176)।
আরও পড়ুন: নারীকে ‘রাখা হবে’ কোথায়: বিশ একুশে মনুসংহিতা (2)
মহাপাতক কাকে বলে?
ব্রাহ্মণ হত্যা, (নিষিদ্ধ) সুরাপান, ব্রাহ্মণের সোনাচুরি, গুরুদারগমন (গুরু হওয়ার অধিকার শুধু ব্রাহ্মণের, অতঃপর ব্রাহ্মণীগমন) এবং এই চার পাতকের দোষীর সঙ্গে সম্পর্ক (11/54)।
ব্রাহ্মণের বেদ ভুলে যাওয়া, বন্ধুকে হত্যা করা, জাল সাক্ষ্য দেওয়া, অখাদ্য খাওয়া এসব মদ খাওয়ার মতোই মহাপাতক (11/56)।
(অগম্যা-গমন) যেমন সহোদরা ভগিনী, কুমারী, চন্ডালী ও বন্ধুপত্নীতে শুক্রনিক্ষেপ গুরুদারগমন তুল্য (11/58)।
গোহত্যাকারী কি মহাপাতক নয়?
না । গোহত্যা উপপাতক বা গৌণপাপ, যার এক লম্বা লিস্টি রয়েছে। যেমন, পরদারগমন, বিনা মৈথুন কোনও কন্যার যোনিতে অঙ্গুলি প্রক্ষেপ, বউকে বেশ্যাবৃত্তি করিয়ে জীবিকা অর্জন, সুদের পয়সায় জীবনযাপন, পড়ানোর জন্যে মাইনে নেওয়া ও দেওয়া, বাপ-মা-বউ-ছেলেমেয়েকে ত্যাগ করা, নিষিদ্ধ দ্রব্যের ভক্ষণ, চুরি, ঋণ শোধ না করা, গবাদিপশুর অপহরণ, মদ্যপায়ী স্ত্রী অভিগমন, নারী-শূদ্র-বৈশ্য-ক্ষত্রিয় হত্যা, নাস্তিকতা আদি প্রায় 60টি (11/66, 67)।
এছাড়া ব্রাহ্মণকে লাঠিপেটা, অখাদ্য ও মদের ঘ্রাণ নেওয়া এবং দু’জন পুরুষ নিজেদের মধ্যে মৈথুন করলে জাত যায় (11/67)।
বোঝাই যাচ্ছে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা 377 যখন আর ক্রিমিনাল অ্যাক্ট রইল না, তখন বিভিন্ন চ্যানেলে অনেক গেরুয়াধারী কেন একে ধর্মবিরোধী বলে নিন্দে করেছিলেন। সমকাম বা প্রেম মনুসংহিতায় পাপ বটে, তবে ‘মহা’ নয়, ‘গৌণ’ পাপ। মনুস্মূতিকে ভিত্তি করেই ওই সন্তদের ভয় ছিল সমকাম আইনসম্মত হয়ে গেলে হিন্দুধর্মের ক্ষতি হবে।
মহাপাতকের প্রায়শ্চিত্ত
অন্য জাতির কেউ ব্রহ্মহত্যা করলে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু ব্রাহ্মণ যদি ব্রহ্মহত্যা করে?
অজ্ঞাতসারে করলে হয় পর্ণকুটির বানিয়ে হত ব্যক্তির বা অন্য কারও মাথার খুলি নিয়ে ভিক্ষা করে 12 বছর বনবাস করবে (11/72)। অথবা অশ্বমেধ, বিশ্বজিৎ বা আরও অনেকগুলো যজ্ঞ করবে (11/74), অথবা এই ধরনের নানা কৃচ্ছসাধন করে পাপমুক্ত হবে। যেমন 12 বছর ধরে স্ত্রীসম্ভোগাদি রহিত হয়ে হবিষ্যান্ন খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে পাপ মুক্ত হবে (11/77, 78, 79)।
জ্ঞাতসারে ব্রহ্মহত্যা করলে ব্রাহ্মণকে এর দ্বিগুণ প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে (11/89)।
চোরে ব্রাহ্মণের স্বর্ণ এবং সর্বস্ব হরণ করলে সেই ধন উদ্ধারের জন্য দরকার হলে তিনবার যুদ্ধ করে (অকৃতকার্য হলেও) হৃত ধন বা তার সমপরিমাণ ধন ব্রাহ্মণকে দিয়ে রাজা পাপমুক্ত হবেন (11/80)।
সুরা হল অন্নের মল এবং মল পাপস্বরূপ, তাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সুরাপান করবেন না (11/93)।
সুরাপান করলে দ্বিজের (উক্ত তিনবর্ণের) অন্যতম প্রায়শ্চিত্ত হল জ্বলন্ত সুরাপান করে নিজ দেহ দগ্ধ করে পাপমুক্ত হওয়া বা জ্বলন্ত গোমূত্র, জল দুধ, ঘি ও গোময়জল মৃত্যু পর্যন্ত পান করা (11/91)।
এই সংহিতা পড়ে জানা যাচ্ছে তখন মদ ছিল তিন রকমের।
পৈষ্টি হল চাল থেকে তৈরি মদ, মাধ্বী তৈরি হয় মধুকবৃক্ষের ফুল থেকে— মহুয়া।
আর গৌড়ী হল গুড় থেকে তৈরি (11/94)।
মনে হয় না ব্রাহ্মণ ভিন্ন এই বিধিনিষেধ কেউ মেনে চলতেন। কোনও পুরাণে সুরাপান মহাপাতক বা নিষিদ্ধ বলে চোখে পড়েনি।
গুরুদারগমন বা গুরুপত্নী গমন হল মহাপাতক।
দোষী পাপ ঘোষণা করে উত্তপ্ত লৌহশয্যায় শয়ন করবে, জ্বলন্ত লৌহনির্মিত স্ত্রী-প্রতিকৃতি জড়িয়ে ধরে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুদ্ধ হবে (11/103)।
অথবা নিজ লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ ছেদন করে অঞ্জলিতে নিয়ে শরীরপাত না হওয়া পর্যন্ত সোজা নৈঋত কোণে গমন করবে (11/104)।
পুরাণকথা অনুযায়ী দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার (গুরুদারা) সঙ্গে ছাত্র চন্দ্রের প্রণয় জন্মেছিল। দুইজনে ইলোপ করেছিলেন। তারপর কী হল জানে শ্যামলাল!
(মাইকেল রচিত বীরাঙ্গনা কাব্যে ‘চন্দ্রের প্রতি তারা’ নামক পত্রকবিতা দ্রষ্টব্য)।
উপপাতক গোহত্যার প্রায়শ্চিত্ত
o গোহত্যাকারী একমাস যবের মাড় খাবেন, মাথা মুড়িয়ে দাড়িগোঁফ কামিয়ে নিহত গাইয়ের চামড়ায় গা ঢেকে গোচারণ ভুমিতে বাস করবেন (11/108)।
o দ্বিতীয় মাসে গোমূত্র দ্বারা স্নান করবেন, সংযতেন্দ্রিয় হয়ে একদিন উপোস করে দ্বিতীয় সন্ধ্যায় হবিষ্যান্ন খাবেন (11/109)।
o এভাবে তৃতীয় মাস পর্যন্ত দিনে গাভীদের পিছন পিছন যাবেন, দাঁড়িয়ে তাদের খুরের ধূলির স্বাদ নেবেন, তাদের সেবা করে ও নমস্কার করে রাত্রে বীরাসনে বসবেন।
o এভাবে তিনমাসে গোহত্যাজনিত পাপ দূর করে তিনি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে একটি বৃষ ও দশটি গাভী (দক্ষিণাস্বরূপ) দেবেন। গাভী না থাকলে ব্রাহ্মণকে সর্বস্ব দেবেন (11/115, 116)।
উপসংহার
আমরা দেখলাম মহর্ষি মনু কোথাও গরুকে মাতা বলেননি। গো-হত্যাকে মহাপাতক বলেননি, গোহত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেননি। আবার বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখছি ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য গরুকে গোধন বলছেন। [4] সর্বত্র দেখছি গরু সম্পত্তির প্রতীক। মহাভারতে বিরাট পর্বে গরু লুন্ঠনকারীদের থেকে বিরাট রাজার কয়েক হাজার গরুকে বাঁচাতে অর্জুন (বৃহন্নলা) গান্ডীব তুলে নিলেন।
গরু মাতা হলে কি তাকে বিক্রি করা বা দান করা যায়?
রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ‘হিন্দুত্ব’ ধারণার প্রণেতা সাভারকর কখনওই গরুকে মাতা বলতে রাজি হননি। বলেছেন চারপেয়ে পশুটি উপকারী, কিন্তু সে আমার মা হবে কী করে? [5]
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সবচেয়ে সফল সরসংঘচালক গুরুজী গোলওয়ালকর অবশ্য তাঁর ‘বাঞ্চ অফ থটস’ বইয়ের ‘অন কাউস্লটার’ শীর্ষক প্রশ্নোত্তরে বলেছেন যে, ভারতে গোহত্যা বিদেশি আক্রমণকারীদের মন্দির-মঠ ভাঙার সঙ্গে শুরু হয়েছিল। তাঁকে বেদে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের মুখে গোমাংস ভোজনের উল্লেখ মনে করিয়ে দেওয়ায় তিনি বলেন— ওটা না বুঝে ভুল ব্যাখ্যার ফল। আসলে যাজ্ঞবল্ক্য গোমাংস খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন মানে ইন্দ্রিয়দমনের কথা বলেছিলেন। এখানে গোমাংস মানে ইন্দ্রিয় বুঝতে হবে।
বাস্তবে কিন্তু গোমাংস বলতে ইন্দ্রিয় বোঝা হয় না। [6]
বৃহদারণ্যক উপনিষদ নাকি ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য লিখেছেন। তাতে পণ্ডিত ও মেধাবী পুত্ররত্ন প্রাপ্তির জন্যে 6/4/18 শ্লোকে ষাঁড় বা বাছুরের মাংসের বিরিয়ানি রেঁধে কর্তা-গিন্নিকে খাওয়ানোর নিদান দেওয়া আছে।
স্বামী গম্ভীরানন্দ শ্লোকটির অনুবাদ করেছেন-
“আর যিনি ইচ্ছা করেন, ‘আমার পণ্ডিত, বিখ্যাত, সমিতিঙ্গম ও রমণীয় বাক্যের বক্তা পুত্র জাত হউক, সে সর্ববেদ অধ্যয়ন করুক এবং পূর্ণায়ু প্রাপ্ত হউক, তিনি তরুণ বা অধিক বয়স্ক বৃষভের মাংসের দ্বারা পলান্ন রন্ধন করাইয়া (স্বামী ও স্ত্রী দুইজনে আহার করিবেন। তাহারা ঐরূপ সন্তানোৎপাদনে সমর্থ হন।”
বৃহদারণ্যক উপনিষদ 6/4/18-এর অনুবাদকালে অনুবাদক সীতানাথ তত্ত্বভূষণ মন্তব্য করেছেন-
“এই যুগে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল না। এই মন্ত্রে গোমাংস ভোজনের ব্যবস্থা দেওয়া হইয়াছে। এখানে বলা যাইতে পারে যে শতপথ ব্রাহ্মণে (3/1/2/21) গোমাংস ভোজন নিষেধ করা হইয়াছে। কিন্তু নিষেধ করিয়াও সেখানে বলা হইয়াছে, ‘হ উবাচ যাজ্ঞবল্কঃ অশ্নামি এব অহম্ অংসলং চেৎ ভবতি’- অর্থাৎ, ‘যাজ্ঞবল্ক্য বলেন, (এই মাংস) যদি অংসল অর্থাৎ কোমল হয়, তাহা হইলে আমি ভোজনই করি’ (৩/১/২/২১) এস্থলে অনড্বান্ (অর্থাৎ বলদ) এবং ধেনুর মাংসের কথা হইয়াছে।“
বরং, নিখাদ গোমাংস হিসেবেই ধরে নিয়ে গোমাতা বধের জন্যে মানুষের প্রাণ নেওয়া হচ্ছে। কোন শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে তা করা হচ্ছে?
--------------------------------------------------------------------------------------
1) ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, 21 জানুয়ারি, 2021
2) দ্য ওয়্যার, 4 এপ্রিল, 2017
3) কৌটিল্য নীতির অন্তর্গত শত্রুকে বশে আনার এই চারটি কৌশল। সাম- মিত্রতা বা আলোচনার (নেগোসিয়েশন) মাধ্যমে। দান- আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণ দিয়ে। ভেদ- ডিভাইড এন্ড রুল; শত্রুশিবিরে গোপনে মতভেদ বা দলাদলি সৃষ্টি করে। দন্ড- বলপ্রয়োগ, শাস্তি ও যুদ্ধ করে।
4) বৃহদারণ্যক উপনিষদে জনকসভায় যাজ্ঞবল্ক্য উপাখ্যান।
5) ‘সাভারকর, দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব’, বৈভব পুরন্দরে, পৃঃ 200-201
6) এমএস গোলওয়ালকর, ‘বাঞ্চ অফ থটস’, পৃঃ 496; সাহিত্য সিন্ধু প্রকাশন, 2018