ব্যাঙ্কের সঙ্গে শিল্পগোষ্ঠীর যোগসাজশে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাঙ্ক আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক এবং বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কাহিনি আগেই বলা হয়েছে। এই অসাধু আঁতাতের ঘটনা কিন্তু একের পর এক ঘটেই চলেছে।
এ’বছর গত অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (নীরব মোদী ও চোকসি জুয়েলার্স দুর্নীতির জন্য ইদানীং শিরোনামে উঠে আসা) রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে জানায় যে, 3800 কোটি টাকার আরও একটা নতুন দুর্নীতি মামলা ধরা পড়েছে। ভূষণ পাওয়ার অ্যান্ড স্টিল লিমিটেড 3800 কোটি লোন নিয়ে ব্যাঙ্ককে ঠকিয়েছে, পয়সা অন্য কাজে খরচ করেছে এবং সেই টাকা এখন আদায় হবার সম্ভাবনা কম, তাই লোনটা অনাদায়ী খাতায় ঢুকেছে।
চারটে ফার্মের সঙ্গে যোগসাজশে ব্যাঙ্কের জমা পুঁজি নয়ছয় করে বেআইনি ভাবে নিজেদের চক মেলানো বাংলো ও অন্যান্য সম্পত্তির মালিক হওয়ার অভিযোগে খোদ ইয়েস ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা রানা কাপুর ও অন্যদের মার্চ 8, 2020 তারিখে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত মাসে সিবিআই রানা কাপুরের মেয়ে রোশনি কাপুর সহ চারটে আরও কোম্পানির, যেমন- DHFL, Belief Realtors Pvt Ltd, RKW Project PVT Ltd, DoIT Urban Ventures (India) Pvt Lt- এর বিরুদ্ধে এই ঠগবাজি মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে চার্জশিট দিয়েছে। শুধু মেয়ে রোশনি জামিন পেয়েছেন।
নীরব মোদী, মেহুল চোকসির মতো গুজরাতের স্বর্ণ ব্যব্যসায়ীদের কেচ্ছা তো সর্বজনবিদিত। বাস্তবে রাজনৈতিক ক্ষমতার আশেপাশে ঘোরাফেরা করে কী ভাবে ব্যাঙ্ক ও জনতাকে দিনের পর দিন ঠকানো সম্ভব, তা এই জুয়েলারি নির্মাতারা হাতে কলমে করে দেখালেন। ক’বছর আগেও দক্ষিণ দিল্লির বড় রাস্তায় হাঁটতে গেলে চোখে পড়ত এদের বিশাল সব চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন। এরা কী ভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারলেন, এবং তাতে সরকারি আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা নিয়ে একসময় সংসদে বহু চাপান-উতোর হয়েছে। একজন ইংল্যান্ডের জেলে অন্যজন এদেশ ওদেশ। কিন্তু জনতার টাকা?
আরও পড়ুন: শিল্পপতিদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক 1: আপনা হাত জগন্নাথ?
ইউনাইটেড ব্রিউয়ারিজ বেচে দিয়ে কিংফিশারের কর্মচারীদের বেতন ও ব্যাঙ্কের বিশাল টাকা বকেয়া রেখে ইংল্যান্ডে পালিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছিলেন বিজয় মালিয়া। তাকে দেশে ফেরানোর আইনি প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরেই চলছে। কিন্তু উনি কাদের যোগসাজশে ভারত থেকে পালাতে পারলেন এবং ইংল্যান্ডে ঘাঁটি গাড়লেন তার সবটা এখনও জানা যায়নি।
কলকাতার ইউকো ব্যাঙ্কের হেড অফিস যশ বিড়লা গ্রুপের চেয়ারম্যান যশোবর্ধন বিড়লাকে এক বছর আগে ‘উইলফুল ডিফল্টার’ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। কারণ, ‘বিড়লাসূর্য্যা’-কে দেওয়া 67.65 কোটি টাকার ঋণ আদায় করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
দেশে বিদেশে বহু কোম্পানির মালিক অনিল আম্বানীর নাম 2008 সাল নাগাদ ভারতের সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় জ্বলজ্বল করত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ধস নামছিল। দেশি ও বিদেশি বড় বড় ব্যাঙ্ক পাওনাদার। রাজনৈতিক প্রভাবে সেগুলি কিছুদিন চেপে রাখা গিয়েছিল। কিন্তু বড় ভাইয়ের সঙ্গে বিবাদ এবং প্রতিযোগিতায় হেরে আজ অনিল দেউলিয়া, আর দাদা মুকেশ বিশ্বের 6 নম্বর ধনী ব্যক্তি।
অনিল আম্বানীর দু’টো অ্যাকাউন্টকে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক এবং ব্যাঙ্ক অফ বরোদা ‘ফ্রড’ অ্যাকাউন্ট ঘোষণা করেছে। ফরেন্সিক অডিটে ধরা পড়েছে, যে কাজের জন্যে ব্যাঙ্ক লোন দিয়েছিল তা অন্য কাজে লাগানো হয়েছে। গত মে মাসে লন্ডনের এক আদালত অনিল আম্বানীকে দুটো চাইনিজ ব্যাঙ্ক ও একটি ব্রিটিশ ব্যাঙ্কের লোন অনাদায়ী হওয়ায় অন্তত 700 মিলিয়ন ডলার পেমেন্ট করতে বলেছে।
অনিল আম্বানী গ্রুপের অনেকগুলো কোম্পানি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। তাদের সম্পত্তি বিভিন্ন পাওনাদার ব্যাঙ্ক দখল করে নিচ্ছে। শেষতম উদাহরণ হল, এ বছর রিলায়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের 2892 কোটি পাওনা টাকা আদায় করতে ইয়েস ব্যাঙ্কের তরফ থেকে সান্তাক্রুজে অনিল আম্বানীর ওই কোম্পানির হেডকোয়ার্টার এবং দক্ষিণ মুম্বইয়ের আরও দু’টো অফিস দখল করে নেওয়া। এ বার স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অনিলের দু’টো কোম্পানি তাদের 1200 কোটি টাকার লোন বকেয়া হওয়ায় দেউলিয়া ঘোষিত অনিলের বিরুদ্ধে কোর্টে গেছে। কারণ ওই দু’টো লোনের ব্যক্তিগত জামিন অনিল নিজে। কিন্তু ব্যাঙ্কের উকিল বলছেন, অনিল প্রাণপণে লড়ছেন যাতে ব্যাঙ্ককে এক পয়সা ফেরত না দিতে হয়। এর আগে এই মামলায় দিল্লি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট স্টেট ব্যাঙ্কের আবেদন খারিজ করে অনিলের পক্ষে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল।
এদের বোধহয় নিজস্ব ব্যাঙ্ক খোলার লাইসেন্স দেওয়াই ভাল! তা হলে হয়তো টাকা সরানোর ব্যাপারটা এক রকম বৈধতাই পেয়ে যাবে. মামলা মোকদ্দমায় আদালতের সময় নষ্ট আর হবে না!
এ বার চোখ ফেরানো যাক ভারতে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের চেহারায়।
ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের 50 তম বার্ষিক অধিবেশনে অক্সফ্যাম এক স্টাডি রিপোর্ট পেশ করে। যার সারমর্ম হচ্ছে যে, ভারতের এক শতাংশ লোকের হাতে জনসংখ্যার 70% সম্পদের চার গুণ বেশি সম্পদ সঞ্চিত হয়েছে। অর্থাৎ দেশের সমস্ত বিলিয়নেয়ারদের সম্পত্তি গোটা দেশের বাজেটের চেয়ে বেশি।
এই সূচিতে সবচেয়ে ওপরে দু’টি নাম— মুকেশ আম্বানী ও গৌতম আদানি।
মুকেশ বর্তমানে গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজকে পেছনে ফেলে বিশ্বের ষষ্ঠতম ধনী ব্যক্তি। বিশ্বের সর্বোচ্চ দশজন ধনীদের ব্লুমবার্গ লিস্ট অনুযায়ী, ওঁর সম্পত্তির মূল্য এখন 75বিলিয়ন ডলার এবং এই লিস্টে উনি একমাত্র এশীয়। মজার ব্যাপার গত এক বছরে, যখন দেশের জিডিপি সমানে কমছে, বাজারে মন্দা, তখন ওঁর সম্পদ বেড়েছে 16.4 বিলিয়ন ডলার।
গৌতম আদানির সম্পত্তি এখন 30.4 বিলিয়ন ডলার। উনি এখন বিশ্বের 40 তম ধনী ব্যক্তি। এই এক বছরে ওর সম্পদ বেড়েছে 19.1 বিলিয়ন ডলার।
আমরা ক্রোনি ক্যাপিটালিজমকে বুঝতে আম্বানী ও আদানি পরিবারের নতুন নতুন শিল্পে পদক্ষেপ এবং তার সঙ্গে সরকারের কিছু নীতির যুগলবন্দি নিয়ে আলোচনা করব। সেগুলি হল টেলিকম, অসামরিক বিমান উড়ান (সিভিল অ্যাভিয়েশন), শিক্ষা, কৃষি ও সামরিক বিমান।
টেলিকম: এয়ারটেল, ভোডাফোন-আইডিয়াকে পিছনে ফেলে জিয়ো-র জয়যাত্রা অব্যাহত। প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর সরকার বিশাল বকেয়া ট্যাক্সের মামলা চাপিয়েছে। ভাই অনিল আম্বানীও প্রতিযোগিতায় হেরে নিজের সংস্থাটি বড়ভাইকে নামমাত্র দামে বেচে দিয়েছেন। কিন্তু ভারত সরকারের বিএসএনএল? বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ টেলিকম কোম্পানি কেন হেরে যায় মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্সের কাছে?
মুম্বইয়ের ইউনিয়ন অফিসে বসে প্রাক্তন টেলিকম ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সূর্যকান্ত মুদ্রা এর কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় তুলে ধরলেন। প্রথমত, মুকেশ এনেছেন নামমাত্র মূল্যে 4জি পরিষেবা, সরকারি ফোন এখনও 3জি, একে 4জি লাইসেন্স দিতে এবং মান্ধাতার আমলের তামার তারের জায়গায় ফাইবার লাগাতে সরকার রাজি নয়। দ্বিতীয়ত, বিএসএনএলে ভলান্টিয়ারি রিটায়ারমেন্টের মাধ্যমে চাপ দিয়ে কর্মীদের অবসরে পাঠানো হচ্ছে, কিন্তু নতুন লোক নেওয়া হচ্ছে না। তৃতীয়ত, কর্মী কমায় পরিষেবার মান কমছে। ফলে দ্রুত গ্রাহক হারাচ্ছে বিএসএনএল।
সোজা কথায়, সরকার চাইছে না এই নিগম চলুক।
অসামরিক বিমান পরিবহণ: এয়ার ইন্ডিয়াকে বেচে দেওয়ার জন্যে গত কয়েক বছর ধরে নিলাম ডাকা হলেও ফল হয়নি। তাতে কী? ভারত সরকার 2019-এর ফেব্রুয়ারিতে ছ’টি প্রধান এয়ারপোর্টকে বেসরকারি হাতে তুলে দিয়েছে। সেগুলি হল লখনৌ, আমেদাবাদ, জয়পুর, ম্যাঙ্গালোর, তিরুঅনন্তপুরম এবং গৌহাটি। এর সবকটির আগামী 50 বছর ধরে দেখাশোনা ও পরিচালনার অধিকার পেয়েছে আদানি গ্রুপ। এর জন্যে নিলামে কড়া প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সে অন্য গল্প।
পরের পর্বে আলোচনা করব শিক্ষা, কৃষির মতো ক্ষেত্রগুলি নিয়ে।
(ক্রমশ)