প্রকৃতির চিত্রপটে নাটকের চরিত্রগুলিকে একত্রিত করে যে এ রকম ছবি আঁকা যায় সেটা বিদ্যাধরীর তীরে বসে ‘দেবী মঙ্গলকাব্য’ না দেখলে হয়তো উপলব্ধি করা যেত না। প্রকৃতির ক্যানভাসে নাটকের এই চিত্ররূপ দেখতে সুন্দরবনের বিদ্যাধরী নদীর (Vidyadhari River)চরের চার নম্বর কলোনি পাড়া যেন ভেঙে পড়েছিল 27 নভেম্বরের প্রদোষকালে।
সূর্য তখন প্রায় অস্তমিত। বিদ্যাধরী জুড়ে তখন এক মায়াবী আলোর ছটা। এই আলোয় এখানকার মানুষগুলো উপলব্ধি করলেন নদীর, প্রকৃতির অনন্য এক রূপ। যে মানুষগুলোর জীবনসঙ্গী প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ইয়াস-এর ক্ষত যাঁদের সংসারে, এলাকায় এখনও জ্বলজ্বল করছে। ঝড়ঝঞ্ঝা যাঁদের নিত্যসঙ্গী। সংস্কৃতি বলতে যাঁদের বৎসরান্তে একমাত্র সম্বল শুধুই ভিডিও শো। তাঁরাই নিজের চোখে, নদীর চরে দেখলেন মণীশ মিত্রের (Manish Mitra) পরিচলনায় নাটক, ‘দেবী মঙ্গলকাব্য’। যার কলাকুশলীরাও সুন্দরবনের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রী। এদের জীবনে এটাই প্রথম অভিনয়। একহাত দূরত্ব থেকে কোনও দিন নাটক না-দেখা এই মানুগুলো নাটকের চরিত্রগুলিকে যেন অন্তরের অন্তস্থলে জায়গা দিয়ে উপলব্ধি করলেন নাটক দেখার দীর্ঘ দিনের ইচ্ছা। হাজারখানেক মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখলেন তাঁদের চেনা মনসামঙ্গল অবলম্বনে কসবা অর্ঘ্য ও ন্যাজাট নাট্যোৎসব কমিটির যৌথ উদ্যোগে নাটক ‘দেবী মঙ্গলকাব্য’ (Devi Mangal Kavya)।
ছবি আকবর হোসেন মল্লিকের তোলা
ন্যাজাট চার নম্বর কলোনি পাড়ার বাসিন্দা রঞ্জন বর। পেশায় বিল্ডার্সের দোকানে হিসাবরক্ষক। তিন দশক তিনি এখানকার বাসিন্দা। তাঁর কথায়: ‘‘নাটক তো দূরের কথা, নদীর চরে এমন নাটক কোনও দিন হতে পারে ভাবিনি, দেখতে পাওয়া তো দূরের কথা। কোনও দিন এখানে কোনও নাটক, গানবাজনার অনুষ্ঠান হয়নি। ন্যাজাট নাট্ট সংস্থার সঙ্গে কসবা অর্ঘ্যর যৌথ প্রয়াসে আজ আমরা দেবী মঙ্গলকাব্য দেখতে পেলাম।’’ বিদ্যাধরী নদীর এই বাঁকের নাম এখানে বেতনী। এই নদীর এ পারটা চার নম্বর কলোনি পাড়া। ও পারটা ন্যাজাট গাজিখালি। এ পারে যখন ‘দেবী মঙ্গলকাব্য’ মঞ্চস্থ হচ্ছে তখন ও পারের গাজিখালির ঘাটের একটিমাত্র আলো এ পারে পড়েছে। সেই আলো যেন ও পারের বাসিন্দাদের হয়ে বলছে, ‘আমরাও দেবী মঙ্গলকাব্য দেখব’।
আরও পড়ুন:নাটক: বাদল দাস
মনসা মঙ্গলকাব্যের প্রধান চরিত্র মনসামঙ্গল হলেও দেবী মঙ্গলকাব্য পালার কেন্দ্রবিন্দু বেহুলা, মনসা নয়। মনসামঙ্গল মনসার মাহাত্ম্য, লোকদেবীর জয়ের কাহিনি। কিন্তু মনসামঙ্গল কাব্যের পদকর্তা নিজের অজান্তেই কখন মনসার পরিবর্তে বেহুলাকেই কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছেন। ‘দেবী মঙ্গলকাব্য’-এ বেহুলার সেই চরিত্রই বর্ণিত হয়েছে। সদ্য বিবাহিত লখিন্দরকে সাপে কাটার পর বেহুলা স্বামীর প্রাণভিক্ষা চেয়ে কলার ভেলায় স্বামীর দেহ নিয়ে জলে ভাসলেন। এই বর্ণনার পাশাপাশি বেহুলার যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়ে নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা গাইলেন, ‘‘বেহুলার মান্দাস জলে ভেসে চলে। বেহুলা নাচনি স্বর্গে চলে।’’ এ ভাবেই মৃত স্বামীর দেহ নিয়ে বেহুলার স্বর্গে যাত্রাকে একা নারীর বিজয় হিসেবে এই আখ্যানে তুলে ধরা হয়েছে।
উপকরণ, ছবি আকবর হোসেন মল্লিকের তোলা
মঙ্গলকাব্য যখন রচনা হয় তখন ময়মনসিংহ গীতিকা রচিত হয়নি। ময়মনসিংহ গীতিকা-র নায়ক মহুয়া। আর মনসামঙ্গলের নায়ক চ্যাংমুড়ি কানি।
দেবী মঙ্গলকাব্য পালার নায়ক বেহুলা। নাটকে বেহুলার শোকে বিহ্বল গ্রামীণ নারীর মুখের সংলাপ বুঝিয়ে দিয়েছে, নারীশক্তিই শক্তির আধার। কেননা বেহুলা তাঁর মৃত স্বামী লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন। এটাই হল দেবী মঙ্গলকাব্যের মূল ভাবনা।
যে সব শিল্পী দর্শকদের সামনে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁদের শিল্প পরিবেশন করেন তাঁদের বলা হয় ‘পরিবেশন শিল্পী’। এঁরাই হলেন অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং সঙ্গীতশিল্পী। পরিবেশন, শিল্পকলা, গান রচনা, নৃত্যপরিকল্পনা এবং নাট্যকুশলতার সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের শিল্পীদের দ্বারা সমর্থিত এবং তাঁরা পরিবেশন শিল্পকলা সঞ্চালন করার মধ্য দিয়ে বাচ্চা এবং প্রাপ্তবয়স্কদের অনুপ্রাণিত করেন, কারণ এটাই তাঁদের মূল লক্ষ্য।
সাজ, ছবি আকবর হোসেন মল্লিকের তোলা
এক জন পরিবেশন শিল্পী যখন একইসঙ্গে অভিনয়ে, গান গাওয়ায় ও নাচে পারদর্শী হন তখন তাঁকে ইংরেজিতে ‘ট্রিপল থ্রেট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ‘ট্রিপল থ্রেট’ শিল্পীদের মধ্যে সুপরিচিত উদাহরণ হচ্ছেন জিন কেলি, ফ্রেড এস্টায়ার এবং জুডি গারল্যান্ড। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া কচিকাচারা দেবী মঙ্গলকাব্যে নিজেদের ‘ট্রিপল থ্রেট’ হিসাবেই তুলে ধরেছিল ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় তাদের পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।
‘দেবী মঙ্গলকাব্য’ চলার সময় প্রাসঙ্গিক ভাবে কণ্ঠ ও বাঁশিতে ইমন, দেশ, সরোদে হংসধ্বনী রাগের সুরমূর্ছনায় বিদ্যাধরীর চরকে এক অনন্য রূপ দিয়েছিল। সঙ্গে পালাগানের সুরে বেহুলার পতিব্রতা নারী হিসাবে কলার মান্দাসে স্বামীর দেহ নিয়ে দৃঢ়চেতা স্বর্গযাত্রা যেন প্রশ্ন করছিল, এই বিদ্যাধরীই কি সেই জলপথ যেখান দিয়ে সাপে কাটা সদ্য বিবাহিত স্বামীর প্রাণভিক্ষার জন্য স্বর্গে রওনা হয়েছিলেন চাঁদ সদাগরের পুত্র লখিন্দরের স্ত্রী বেহুলা? বেহুলার যাত্রাপথের বর্ণনায় তখন কচিকাচাদের গলায় গীত হচ্ছে, ‘বেহুলার মান্দাস জলে ভেসে চলে, বেহুলা নাচনী স্বর্গে চলে। প্রাণহীন পতি তাঁর কোলে লখিন্দর, ভাসিয়া ভাসিয়া পাইল বাঁকা দামোদর।’
কেন শহর ছেড়ে প্রকৃতির কোলে এই নাটক পরিবেশন? নাট্যকার, পরিচালক মণীশ মিত্র বললেন, ‘‘বিশ্বের সমস্ত শহরেই থিয়েটার একটা গ্ল্যামার চর্চার দমবন্ধ পরিবেশে পরিণত হয়েছে। জীবনের আসল স্পন্দনটা সেখানে ধরা যাচ্ছে না। অথচ থিয়েটার এমন একটা মাধ্যম যেখানে জ্যান্ত মানুষ জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে তাঁদের হৃদস্পন্দন, বেঁচে থাকার আনন্দ, শরীরের ওম অনুভব করেন, করতে পারেন। কিন্তু সেটা শহরে ঘটছে না শহরের থিয়েটারে।’’ মণীশের কথায়: ‘‘ন্যাজাট নাট্যোৎসব কমিটির সঙ্গে আমার আত্মীয়তা। তাই তাদের আহ্বানে মনে হল এখানকার বন, এখানকার নদী, এখানকার মাটি নিয়ে একটা প্রযোজনা হতে পারে, তাই এই কাজ। এর মধ্যে অন্য কোনও ভাবনা নেই মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিকে সম্পৃক্ত করে থিয়েটার করা ছাড়া। এটাকেই আমি অর্গানিক থিয়েটার (Organic Theatre)নাম দিয়েছি।’’ নাট্যকার বাদল সরকারও মানুষের সঙ্গে, মানুষকে পাশে নিয়ে নাটক করতেন। তাঁর এই নাটক থার্ড থিয়েটার নামে পরিচিত।
প্রস্তুতি, ছবি আকবর হোসেন মল্লিকের তোলা
তবে প্রকৃতিই যে সব সৃষ্টির মূলে এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হলেই যে আমাদের অন্তরের সমস্ত অনুভূতিগুলো প্রকাশ পায়, সেটা ধরে রাখতেই কলকাতার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মঞ্চ ছেড়ে নদী,বন,পাহাড়,মাটিকেই বেছে নিয়ে কাজ করতে চান মণীশ মিত্র। মণীশ মিত্রর ভাবনায়, "থিয়েটার বিশেষত এমন একটা মাধ্যম, যেখানে জ্যান্ত মানুষের ভেতরের যে লিভিং অর্গানিজমটা থাকে সেটা একটা অনুরণন তৈরি করে। এটা একটা শক্তি, এই শক্তিটা অনেক মানুষকে একটা অংশগ্রহণকারী উদযাপনে উদ্বুদ্ধ করে। এটা করতে গেলে শহুরে মানুষের শরীরে, মনে যে মানসিক দূষণ তৈরি হচ্ছে সেটাকে কাটিয়ে প্রকৃতি থেকে গ্রিন এনার্জি নিতে হবে। আর গ্রাম বাংলায় বিশ্বায়নের প্রভাব পড়লেও এখনও লোকাচার, শিল্প ,সংস্কৃতি বেঁচে আছে। এর মধ্য থেকেই নিজের শিকড়ের একটা অনুসন্ধান করার মতো উপাদান পাওয়া যায়। আমরা নাটকে মূলত এই জিনিসটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। মেঠো আধারে আমরা এই কাজটা করতে চাই। আমি শহরের চাইতে গ্রামে-গঞ্জে বেশি মিশে চলি। আমি বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাবি না। সেভাবে প্রকৃতিকে ধরাও যায় না।'
তবে থিয়েটারের বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে মণীশ মিত্রের কোনও আপত্তি নেই। তাঁর কথায়, ‘‘থিয়েটার বাণিজ্যিক হোক। শিল্পী বাঁচুন। সেটা এত কাল সে ভাবে ভাবা হয়নি। সবাই ভেবেছেন নাটক করছি মানে কি যেন একটা বড় কিছু করছি। যা সাধারণের বোধের বাইরে। আমি এটা মানি না।’’ পাশাপাশি মণীশ বলেন, ‘‘তবে বাণিজ্যিকরণের নামে তারকাদের প্রমোট করা, ভেজাল, বাজে, কুষ্ঠিত জিনিস দিয়ে তাকে ভরিয়ে তোলা, যেটা আমার শিল্পের সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে, বেঁচে থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, শুধু বিক্রির জন্য, বক্স অফিসের দিকে তাকিয়ে যদি তাকে পণ্য করা হয়, বিক্রি করা হয় সেটা খুব বেদনাদায়ক।এই প্রবণতাকে আমি দোষী করছি।’’ এই নাট্যব্যক্তিত্ব মনে করেন, বাণিজ্যিক হওয়া আর পেশাদার হওয়ার মধ্যে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। মণীশ বলছেন, ‘‘আমি চাইছি এই কাজটা করতে, থিয়েটারের সঙ্গে পর্যটনকে এক করে দিতে। ক্ষতি কি যদি কেউ থিয়েটার দেখতে গ্রামে আসেন, থিয়েটার দেখার পর পিঠেপুলি খান। তাতে তো শিল্প বাঁচে।’’
বিজেপিকে পিছনে ফেলে কলকাতায় দ্বিতীয় স্থানে বামেরা
মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারি বাড়ছে, বিপর্যস্ত ভারতীয় অর্থনীতি, নরেন্দ্র মোদী ব্যস্ত গঙ্গাস্নানে
নজরে করোনা, আড়ালে বাড়ছে না তো ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া?
দেশবন্ধুর স্বপ্নের প্রাথমিক স্কুলের ভাবনাকে সার্থক করতে ব্যর্থ কলকাতা পুরসভা
Retro Fitting পদ্ধতিতে ডিজেল চালিত বাসকে সিএনজিতে রূপান্তরিত করায় মত নেই বিশেষজ্ঞদের।
অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া সিপিএম বিজেমূল ভুল বলে মেনেও যেন মানতে পারছে না।