বিশ্বকর্মা পুজো মানেই আকাশে ঘুড়ির মেলা, বিভিন্ন ছাদ থেকে উচ্চনাদে ভেসে আসা গান— আমার মফঃস্বল জীবনের এ এক পরিচিত দৃশ্য। মহামারীর ভয় কাটিয়ে সেই দৃশ্য এবারেও খানিক দেখা গিয়েছে। সকালের ঝলমলে আকাশ যখন মধ্যাহ্নে ঘন কালো হয়ে বৃষ্টি নামাল, দেখলাম পাশের আমগাছটায় একটা সুদৃশ্য ঘুড়ি ভিজে গেছে। কিছুক্ষণ পর শুধু ঘুড়ির কাঠামোটাই দেখা গেল। আবরণখানা জলে কোথায় যে ধুয়ে গেছে...
মফঃস্বল শহরে গঙ্গা লাগোয়া অজস্র জুটমিল এভাবেই ভাঙাচোরা কাঠামোটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের ট্রেড ইউনিয়ন অফিসে একটা ছোট বিশ্বকর্মাকে বসিয়ে আমোদ উল্লাসে মেতেছেন শ্রমিক মহল্লার ছেলেপুলেরা। ঘনঘন লকআউট, শ্রম কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকেও রফাসূত্র না মেলা কিংবা পুজো শিয়রে এলেও বোনাস না হওয়ার চিন্তা— এসবের থেকে কিঞ্চিৎ অবসর মেলে এই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন।
হঠাৎই যেন ছিঁড়ে গেছে স্বপ্নের সুতোটা। পাশের বাড়ির শ্যামল মেধাবী ছেলে, নামী কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে চাকরির পরীক্ষায় বসার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিচ্ছিল৷ বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন জানাল, বছর তিনেকের জন্য গোরখপুর চলে যাচ্ছে। সেখানে সে হাজার দশেক টাকার চাকরি পেয়েছে। থাকা খাওয়া ফ্রি। আগে ঘুড়ি কাটার ‘ভো-কাট্টা’ উল্লাসে আনন্দ হত। এখন বিরক্তি আসে। চিরটাকাল রাজনীতির লাটাই বল্গাহীন হয়ে কাটাকুটি খেলে গেল, আর আমাদের ছেলেরা ভো-কাট্টা হয়ে উড়ে গেল কে কোথায়, খবর মিলল না।
আজ রবিকাকার টোটো বন্ধ। তার কথায়, ‘আজ ফুলটু মস্তির দিন’। অন্যান্য দিন টোটো স্ট্যান্ডে টোটো রাখতে হলে লোকাল নেতাকে কিছু দিতে হয়। আজ লোকাল নেতাই রবিকাকাদের কিছু দেবে। একটু পরেই খানাপিনা, রবিকাকা ঠিক করেছে, তারপরই লোকাল নেতার সামনে চিৎকার করে কৈফিয়ত চাইবে, শিল্প কই, চাকরি কই বলে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সবাই সবার বন্ধু, কেউ কিচ্ছুটি মনে করবে না নিশ্চয়ই!
আরও পড়ুন: ভিক্ষা নয়, স্বাধিকার
কারিগরদের দেবতা বিশ্বকর্মা। তাই দেবমূর্তির হাতে প্রতীকী ছেনি হাতুড়ি। কিন্তু কান পাতলে ঠকাস ঠকাস আওয়াজ শোনা যায় কই? কলকারখানাগুলো কি নিস্তব্ধ হয়ে কোনও বিরহী কবিকে কবিতা লেখার ফুসরত করে দিচ্ছে? জুটমিলের শ্রমিক প্রদীপদাকে বললাম কারখানায় যন্ত্র ঘোরার আওয়াজ পাও? বেমালুম বললে, ‘কানে কম শুনি, আসলে কম শোনার চেষ্টা করি এখন।'
সামনে বয়ে যায় গঙ্গা। স্মৃতির সরণী হয়ে বেয়ে যায় শিল্পায়ন, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, SEZ, জমি অধিগ্রহনের মতো লব্জগুলো। পুজো ফুরোলেই গঙ্গায় যাবে মূর্তিগুলো। লাউডস্পিকারের গান আর উদ্দাম নৃত্য ছেড়ে পরের দিনের সকালে রবিকাকা, প্রদীপদারা শূন্য চোখে কাজের সন্ধানে যাবে। ভাসানে যাওয়া জমায়েত বলবে, ‘বলো বিশ্বকর্মা কি...জয়! আসছে বছর আবার হবে।' নেতা, দাদাদের কল্যাণে হবে তো বটেই, প্রয়োজনে সংখ্যায় একটু বেশিই হবে। কিন্তু এমন শূন্য কারখানা আর দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই কি বিশ্বকর্মা অধিষ্ঠান করে যাবেন বরাবরের মতো?
এত দলের এত খেলায় পাবলিকের দমবন্ধ না হয়ে আসে!
বন্ধ হরতালময় শহরে এমন দিনগুলোয় সচরাচর ছেলেরা পথে ক্রিকেট খেলে, স্থানীয় চায়ের ঠেকে আড্ডা জমে।
জীবনের সায়াহ্নে এসে পরিচিত মানুষদের শঠতা, কৃতঘ্নতায় আঘাত পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
এই কঠিন সময়ে বিরোধীরাও দেশকে সঠিক দিশা দেখাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সঙ্কটে পড়বে ভারতই!
আচ্ছা মৃত্যুর পর কী? মৃত্যুতেই কি সবকিছুর পরিসমাপ্তি নাকি, তার মধ্যে থেকেই সৃষ্টির বীজ উপ্ত হয়?
স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস পদ্মফুল আর লেজার শো দিয়ে তারাই ঢাকতে পারে, যারা সেই সংগ্রামের শরিক নয়।