লাল রঙা আয়তাকার পোস্টারে ছয়লাপ শহর, শহরতলি, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলও। পোস্টারগুলিতে সাদা হরফে বাংলা এবং ইংরেজিতে বিজেপিকে একটিও ভোট না দেওয়ার আবেদন। কিন্তু দেওয়ালে দেওয়ালে কারা সাঁটাচ্ছে এমন পোস্টার? জল্পনা শুরু হয় তাই নিয়েই।
পোস্টারে কোথাও কোনও দল বা সংগঠনের নাম নেই। কারও মতে এটা বাম দলের ছাত্র-যুবদের কাজ। কেউ কেউ মনে করছিলেন, এটা হয়তো তৃণমূলের ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা আই-প্যাকের কাজ। কিন্তু পরে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, এদের কেউই এই পোস্টারকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। তবে এর নেপথ্যে রয়েছেন কারা?
চলতি বছরের শুরুতেই কলকাতার একটি সভাঘরে পথচলা শুরু করেছিল একটি নয়া মঞ্চ, ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা। মূলত এই মঞ্চের উদ্যোগ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় এই প্রচার চালানো হচ্ছে বিভিন্ন দিকে। কিন্তু ভোটমুখী বাংলায় কেন নতুন মঞ্চ তৈরি করতে হল? কেনই বা বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার আর্জি জানাচ্ছে এই মঞ্চ? এই প্রসঙ্গে মঞ্চের অন্যতম আহ্বায়ক কুশল দেবনাথ জানিয়েছেন, ‘গত সাত বছরে বিজেপির শাসনে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংখ্যালঘু মানুষরা নানা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা খর্ব করা হয়েছে।' একইসঙ্গে তাঁর দাবি, ‘বিজেপি এবং সংঘ পরিবার তাঁদের বিদ্বেষের রাজনীতি বাংলাতেও আনতে চাইছেন। কিন্তু বাংলা সংঘ পরিবারের রাজনীতিকে কখনও সমর্থন করেনি, করবেও না। তাই সার্বিকভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলার মানুষকে সংহত করতেই এই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।'
কিন্তু জনমানসে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার কথা বলা হলেও, তার পরিবর্তে কাকে ভোট দেওয়া উচিত সে কথা বলা হয়নি। এক্ষেত্রে মঞ্চের বক্তব্য হল, বিজেপির বিরুদ্ধে যে কোনও দলকেই ভোট দিতে পারে মানুষ। মঞ্চ কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে ভোট দেওয়ার কথা বলছে না। কিন্তু বিজেপি বাংলায় ক্ষমতায় এলে রাজ্যের কী বিপদ হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করেই তাদের ভোট না দেওয়ার আবেদন জানানো হচ্ছে।
রাজনৈতিক মহলেও শোরগোল পড়ে গেছে এমন অভিনব প্রচার দেখে। শাসক তৃণমূল এই বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি না হলেও, বামেদের একটা অংশ মনে করছেন, ‘ফ্যাসিস্ট’ বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার আবেদন রাখার পাশাপাশি আধা ‘ফ্যাসিস্ট’ তৃণমূলকেও ভোট না দেওয়ার কথা বলা উচিত। বিজেপি অবশ্য পুরো বিষয়টাতেই তৃণমূলের হাত দেখছে। মঞ্চ কি তবে তৃণমূলের নির্দেশেই কাজ করছে? কুশলবাবু বললেন, ‘এসব অমূলক অভিযোগ। রাজ্যের তৃণমূল সরকার আমার বিরুদ্ধে দমনমূলক ইউএপিএ আইনে মামলা করেছিল। কিন্তু, বিজেপির মতো ভয়ঙ্কর, প্রতিহিংসাপরায়ণ দল দেশে আর দু'টো নেই। বিজেপির সঙ্গে অন্য কোনও দলকে মেশালে বিজেপির ফ্যাসিবাদী মনোভাবকে লঘু করে দেখানো হবে।'
মঞ্চের তরফে জানা গেল রাজ্যের 294টি বিধানসভা আসনের 90টিতে ইতিমধ্যেই প্রচারমূলক কর্মসূচি চালানো হয়েছে। অন্যত্রও একইভাবে কর্মসূচি চালানো হবে। মূলত বিভিন্ন ছোটবড় গণসংগঠনের সদস্য এবং ছাত্র-যুব, পড়ুয়ারাই এই প্রচারের পুরোভাগে থাকছেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই এর আগে কোনও দল বা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে একজন জানালেন, ‘সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে পোস্টারিং করতে গিয়ে মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। কলকাতার মিডিয়া বিজেপির পক্ষে হাওয়া তুললেও গ্রামেগঞ্জে মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে।'
ইতিমধ্যেই ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’'-র এই প্রচারাভিযান সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও উঠে এসেছে। প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ, সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা সোশাল মিডিয়ায় এই প্রচারাভিযানের কথা তুলে ধরেছেন। রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের মুখেই যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি ‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চের ‘রাজনৈতিক’ প্রচারে সরগরম এখন রাজ্য রাজনীতি।