রামচন্দ্রকে তো আমি মানুষ বলেই মনে করি না, ভগবান তো দূরের কথা!'
"ভোটের ফল বের হওয়ার পর ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি যে না দেবে, তার এই বাংলায় ঠাঁই হবে না।'
দ্বিতীয় কথাটা, সকলেরই জানা, পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে এসে বলেছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ। প্রথম বাক্যটি এবারের ভোট পর্বে রাজনীতির বর্বরতা এবং হিংস্রতা টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে দেখতে তিতিবিরক্ত 83 বছরের বয়স্ক এক বাঙালি মহিলার।
‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে কেন বাঙালির মন, বিশেষত বাংলার নারীর মন, কোনও দিন জয় করা যাবে না, তার উত্তরটা ওই বৃদ্ধার ব্যাখ্যা থেকেই বেরিয়ে আসে, ‘শুধু লোকনিন্দার ভয়ে, রাজ্যের জনরব শুনে, যিনি নিজের গর্ভবতী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেন, তাঁকে কী করে মানুষ বলব? বিশেষ করে তার আগেই যখন একদফা অগ্নিপরীক্ষা হয়েছে সীতার, অগ্নিদেব তাঁকে অপাপবিদ্ধা বা অকলঙ্কিতা বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তার মানে সীতা নিরপরাধা জেনেও রামচন্দ্র তাঁকে পরিত্যাগ করলেন। এটা কোনও মানুষের কাজ হতে হতে পারে?’
ওই মহিলা একলাই এই ভাবনার বাহক নন। বাঙালির ভাবনাকে বুঝতে বিজেপি-র অনেক ভুলের মধ্যে এটা ছিল অগ্রগণ্য: বাঙালির মননে রামচন্দ্র কখনওই আদর্শ শাসক নন, কারণ তিনি বিবাহিতা (উপরন্তু গর্ভবতীও বটে) স্ত্রীকে অকারণে বর্জন করেছিলেন। তিনি শাসকের কর্তব্য পালন করেননি, জেনেবুঝে অন্যায় অবিচার করেছিলেন।
রামচন্দ্রের স্ত্রী পরিত্যাগের ‘অপরাধটা’ হিন্দি বলয়ে অতটা ধর্তব্যের নয়। অন্তত বাঙালির কাছে যে মাত্রার, ততটা তো নয়ই। রামচন্দ্রের সম্পর্কে ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ কথাটা বাংলায় আগে শোনা যেত না, বিজেপির হাত ধরেই তার আত্মপ্রকাশ। কেন হিন্দি বলয়ের মানুষের সাধারণ ভাবনার থেকে বাঙালির সাধারণ ভাবনা আলাদা (দু’পক্ষেই নিশ্চয় প্রচুর ব্যতিক্রমও আছে) তা পণ্ডিতরা বলতে পারবেন। তবে বাঙালি রামায়ণের নায়ক রামচন্দ্রকে মোটেই আদর্শ পুরুষ বলে মানে না। তার জন্য কারা দায়ী? বিজেপি এবার তাদের ভোটের প্রচারে যে সব বাঙালি মনীষীর নাম অহর্নিশ উচ্চারণ করছে – সেই বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, তার সঙ্গে রামমোহন রায় প্রমুখর কিছু অবদান নিশ্চয়ই আছে। রামকৃষ্ণর সঙ্গে বাঙালি একাসনে বসিয়েই যে সারদা মায়ের আরাধনা করে, তাঁর এবং সেই ভাবনারও হয়তো কিছু অবদান আছে।
আসলে পাণ্ডিত্য তো দুই প্রকারের হয়। প্রথমটা হল বিষয়ের সঙ্গে দীর্ঘ দিন যুক্ত থেকে তাকে আত্মস্থ করা। আর দ্বিতীয়টি হল সহজিয়া পথ – বইয়ের ব্লার্ব মুখস্থ করে অথবা আজকের দিনে উইকিপিডিয়া এবং হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠের পথ। বিজেপি যদি এই দ্বিতীয় পথ অনুসরণ না করত, তা হলে বুঝতে পারত ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনির প্রতি কোনও আন্তরিক আকর্ষণ বাঙালির নেই। বস্তুত তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়য় ওই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনে একবার সংযম হারিয়ে যদি জনতার দিকে তেড়ে না যেতেন, তা হলে এবারের ভোটে ওই হুঙ্কার এতটা শোনা যেত কিনা সন্দেহ। মমতাকে উত্তেজিত করার লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে বিজেপি ভুলে গিয়েছিল যে এই ধ্বনি বাঙালিকে মোটেই উজ্জীবিত করে না।
রামায়ণ বাঙালির প্রিয় মহাকাব্য নয়। বাঙালির হৃদয় জুড়ে আছে মহাভারত। রামায়ণের নায়ক রামচন্দ্র নয়, বাঙালির মহাকাব্যের মহানায়ক শ্রীকৃষ্ণ। কলকাতা শহরে রামমন্দিরের সংখ্যা হাতে গোনা, কৃষ্ণ ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে শুরু করে হিন্দু গৃহস্থের ঠাকুরের আসনে, সর্বত্র। বাংলা এবং বাঙালির সংস্কৃতি নিয়ে বিজেপির চর্চাটা যদি হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের না হয়ে সিরিয়াস হত, তবে এগুলি তাদের নজরে পড়ত। এগুলো তো হাতি-ঘোড়া কিছু বিষয় নয়। বাঙালি মনন নিয়ে একটু নাড়চাড়া করলেই –এমনকি বিজেপিরই বাঙালি নেতাদের ভাবনাকে একটু মন্থন করলেও - এগুলো জানা যেত। কিন্তু ‘এক দেশ এক জাতির’ মন্ত্র উচ্চারণ করা দলের বুঝতে অসুবিধা হয়েছিল যে, দিল্লি থেকে হিন্দিভাষী আর্যাবর্ত পেরিয়ে আসা এই রাজনীতির রথের চাকা বাংলার পলিমাটিতে বসে যাবে। বরং 56 ইঞ্চি বুকের ছাতির গর্ব করা, প্রবল পুরুষতান্ত্রিক, নারীবিদ্বেষী ভিন্নভাষী একদল পুরুষ যখন খর্বকায় এক মহিলাকে ঘিরে ধরে, তখন তার সঙ্গে মহাভারতের আর এক নায়কের তুলনাই বরং বাঙালি করে। কর্ণ। মহাভারতের এই ট্র্যাজিক হিরো আপামর বাঙালির কতটা প্রিয় তার খবর দিল্লির শাসকের কাছে সম্ভবত ছিল না। রামায়ণের কাহিনিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেও রামচন্দ্রের শত্রুর ছেলেকে হিরো বানিয়ে বাংলায় অমর কাব্য সৃষ্টি হয়েছে, সেটাও কি তাদের জানা ছিল?
বাংলা দখলের লড়াই আবার আসবে পাঁচ বছর পর। অনেক সময় আছে। হিন্দুধর্মত্যাগী এক মহাকবির একটি কাব্য হিন্দুত্ববাদীরা পড়ে দেখতে পারেন: ‘মেঘনাদবধ কাব্য’।